আমি সোফায় বসে আপুর মতো টেবিলে পা তুলে দিলাম। আপু চোখের কোণা দিয়ে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলতে পারল না, নিজে টেবিলের উপর পা তুলে রেখে আমাকে কেমন করে পা নামাতে বলে। আমিও চোখের কোণা দিয়ে আপুর দিকে তাকালাম। হাতে একটা ইংরেজি বই কেন তার ভাব দেখানোর জন্য ইংরেজি বই নিয়ে বসতে হবে কে জানে।
আমি আমার বইটা খুলে বসলাম, এতক্ষণ বইটা খুলে বই পড়ার ভান করছিলাম এখন আসলেই পড়া যেতে পারে। ভয়ংকর একটা রহস্যোপন্যাস। প্রতি পৃষ্ঠায় একটা করে খুন হচ্ছে। আর কী বীভৎস সেই খুন পড়লেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। আমি পড়তে শুরু করলাম। বইটাতে যখন আরো দুইটা নতুন খুনের বর্ণনা শেষ করেছি তখন মিঠুন এসে ঢুকল। সে এই বাসার সবচেয়ে ছোট সেই জন্য তার আদর সবচেয়ে বেশি। বেশি আদরের কারণে সে ভয়ংকর একজন নেকু বাচ্চা হিসেবে বড় হচ্ছে। তার হাতে একটা খেলনা ব্যাটম্যান। আমার কাছে এসে তার নেকু নেকু গলায় বলল, “ভাইয়া, কে বেশি পাওয়ারফুল, ব্যাটম্যান নাকি স্পাইডারম্যান?”
ন্যাকামি দেখে মরে যাই! ইচ্ছা হলো কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দেই কিন্তু আপুর কাছে বসে বসে সেটা তো আর করতে পারি না তাই মুখ গম্ভীর করে বললাম, “ব্যাটম্যানও না স্পাইডারম্যানও না। সবচেয়ে বেশি পাওয়ারফুল হচ্ছে চিকাম্যান।”
“চিকাম্যান?” মিঠুন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ। চিকা দেখিস নাই, চিকা? এই মোটা মোটা, ভোটকা ভোটকা? ইন্দুরের মতো। সেই চিকাম্যান।”
মিঠুন কেমন যেন অবাক হয়ে বলল, “চিকাম্যানের নাম কখনও শুনি নাই।”
“কীভাবে শুনবি। এটা থাকে কুড়িল বস্তিতে। এটা তো আর ব্যাটম্যান আর স্পাইডারম্যানের মতো আমেরিকায় থাকে না”।
গাধাটার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে আমি ইয়ারকি করছি। যখন বুঝল তখন আঁ আঁ করে কাঁদার মতো একটা ঢং করে গেল আপুর কাছে, গিয়ে নালিশ করল, “আপু দেখো ভাইয়া আমার সাথে ঠাট্টা করে। আঁ আঁ “
আমি বললাম, “ঠাট্টা? আমি কখন ঠাট্টা করলাম?”
মিঠুন বলল, “আঁ আঁ আঁ–”
আপু তখন তার কঠিন মুখটাকে আরেকটু কঠিন করার চেষ্টা করে বলল, “দেখ টোপন, কাজটা ভালো হচ্ছে না। মিঠুন ছোট একজন মানুষ তাকে নিয়ে এভাবে ইয়ারকি করছিস কেন? একটা প্রশ্ন করেছে ঠিক করে তার উত্তর দে”
‘“আমি ঠিক করেই উত্তর দিয়েছি। সবচেয়ে পাওয়ারফুল হচ্ছে চিকাম্যান। চিকা একটা ব্যাটকেও খপ করে কামড় দিতে পারে স্পাইডারকেও পারে”
“খবরদার টোপন ঢং করবি না। ছোট একজন বাচ্চাকে এভাবে টিজ করতে হয় না।”
“ছোট? মিঠুনের বয়স হয়েছে আট। আট বছর বয়সে আমি ওয়ার এন্ড পিস পড়েছি।”
আসলে পড়ি নাই, কিন্তু কথা বলার সময় একটু বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলতে হয়। আপু সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল, চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুই ওয়ার এন্ড পিস পড়েছিস?
“পুরাটা শেষ করতে পারি নাই।” কথাটা একেবারে মিথ্যা না। আসলে মনে আছে বইটা উল্টে পাল্টে দেখে ভাবছিলাম কোন পাগল এরকম মোটা বই লিখতে পারে আর কোন বোকা এটা পড়তে পারে। কিন্তু সেটা আর বললাম না।
আপু হাল ছেড়ে দিয়ে মিঠুনকে আদর করে বলল, “আস ভাইয়া আমার কাছে। টোপন তোমার সাথে ঠাট্টা করছে। চিকাম্যান বলে কেউ নাই।”
“ভাইয়া সব সময় আমাকে জ্বালায়।”
“আমি জানি। টোপন হচ্ছে দুষ্টু, সেই জন্য জ্বালায়। তুমি কখনো দুষ্টু হবে না। তুমি হবে গুডি বয়।”
আমি বললাম, “গুডি বয় বলে কোনো শব্দ নাই। শব্দটা গুড বয়। আর তোমার বলা উচিত নেকু বয়। ন একারে নে ক উকারে কু। নেকু।”
আপু চোখ লাল করে বলল, “চুপ করবি তুই? আম্মুকে বলে দেব কিন্তু।” আমি বুঝলাম আমার আর এখানে বসে থাকা ঠিক হবে না। তাই উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বললাম, “আরেকটা কথা আপু। তুমি যে ইংরেজি বইটা নিয়ে পড়ার ভান করছ, সেটা বানান করে পড়তে পড়তে তোমার কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। তখন তোমার বয়স হবে ষোলো। বিয়ের বয়স। এখন থেকে একটা ছাগল টাইপের জামাই ঠিক করে রাখ।”
আপু রেগে মেগে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “তবে রে বদমাইশ–”
আমি তখন এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। মিঠুনকে কাঁদিয়ে এবং আপুকে রাগিয়ে মনের ভিতরে একটা ফুরফুরে আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে। একটা কাজের কাজ করতে পেরেছি।
এটা হচ্ছে আমার দৈনন্দিন জীবন। খারাপ না।
০২. সায়েন্টিস্টকে কে পাত্তা দেয়
০২.
এতোদিন মামাকে বেশি পাত্তা দেই নাই। কেন দিব? একজন সায়েন্টিস্টকে কে পাত্তা দেয়? ক্রিকেট প্লেয়ার হলে একটা কথা ছিল কিংবা ব্যান্ডের গায়ক। পুলিশ কিংবা র্যাব হলেও কথা ছিল, হাতে রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। সায়েন্টিস্টদের মতো শান্তশিষ্ট ঢিলেঢালা নিরীহ মানুষদের কে পাত্তা দেয়? কিন্তু যখন আমি আবিষ্কার করলাম মামা তার বগলের নিচে একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন এক লাফে আমার কাছে মামার সম্মান একশ গুণ বেড়ে গেল। প্রথমবার মামাকে পাত্তা দিতে শুরু করলাম।
মামা আমাদের বাসায় কয়েকদিন থাকবেন, আমি এখন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। মামা যেন টের না পায় সেভাবে তাকে চোখে চোখে রাখলাম। মামা কী করে, কার সাথে কথা বলে কী নিয়ে কথা বলে, কম্পিউটারে কী টাইপ করে, কাগজে কী লিখে, কী কাগজ পড়ে, কি দেখে খুশি হয়, কী দেখে রাগ হয়, কখন দাঁত কিড়মিড় করে কখন নিজে নিজে হাসে এই সব কিছু দেখে দেখে আমি বুঝে গেলাম মামা আসলে কী করছে।