আমি চিৎকার করে উঠলাম, “মামা!”
মামা ঘুরে আমার দিকে তাকালো, আমি তখন বুঝতে পারলাম, মামার হাত দুটো পিছনে বাঁধা শুধু তাই না আমি বুঝতে পারলাম মামাকে এই জানোয়ারগুলো মেরেছে। হঠাৎ করে আমার ভিতরে অসহ্য রাগ পাক খেয়ে উঠল, মনে হলো আমি বুঝি সবার চোখ খাবলে তুলে নিতে পারব।
মামা দুর্বল গলায় বলল, “তোকেও ধরে এনেছে!”
“হ্যাঁ মামা।”
“কী আশ্চর্য। তুই না একটা বাচ্চা ছেলে। দশ বছর বয়স।”
“বারো।”
“একই কথা।”
বাঙালি মানুষটা আমার গলায় ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিল। লাল মুখের মানুষটা তখন আমাকে খপ করে ধরে আমার হাত দুটো পিছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলল, “গো টু হেল। জাহান্নামে যাও।”
আমি মেঝেতে পড়ে থেকে সেই অবস্থায় চি চি করে বললাম, “ইউ গো টু হেল।” তুমি জাহান্নামে যাও।
মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে এলো, রাগে তার মুখটা থম থম করছে। বুট পরে থাকা পা দিয়ে মানুষটা আমার পাঁজরে একটা লাথি দিল এবং আমি সেই লাথি খেয়ে প্রায় দশ হাত দূরে ছিটকে পড়লাম। আমার প্রথম মনে হলো আমি মরে গেছি। নিঃশ্বাস আটকে ছিল, অনেক কষ্টে বুক থেকে বের করে মনে হলো এখনো মরিনি কিন্তু আর দুই মিনিটের মাঝে মরে যাব। দুই মিনিট পরে মনে হলো এবারের মতো বেঁচে যেতে পারি। তখন চোখ খুলে তাকালাম। দেখলাম ঘরটা খালি, শুধু মামা আমার উপর ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি চোখ খোলার পর মামা আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল, বলল, “অনেক ব্যথা লেগেছে?”
আমি বললাম, “মোটামুটি।”
“জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নে। তারপর উল্টো দিক দিয়ে একশো থেকে এক পর্যন্ত গুণে আয়।”
আমি হাসার মতো ভঙ্গী করে বললাম, “আমি এক থেকে একশ পর্যন্ত সোজা দিকেই কখনো গুণি নাই!”
মামা একটু নড়েচড়ে পিছনে সরে দেয়াল হেলান দিয়ে বসল। বলল, “তোকে আমার সাথে আনাটা ঠিক হয় নাই। অনেক বড় গাধামো হয়েছে।”
“না মামা, গাধামো কেন হবে?”
“হয়েছে। এরা খারাপ মানুষ। খুব খারাপ। দেখলি না তোর মতো বাচ্চা ছেলেকে কীভাবে মারল। অনেক ব্যথা লেগেছিল?”
“হ্যাঁ মামা। এখন ঠিক হয়ে যাচ্ছে।”
“ভয় পাস না, ঠিক হয়ে যাবে।”
মামাকে এখনো বলিনি যে আমি তার পিস্তলটা নিয়ে এসেছি। সেটা ব্যবহার করতে চাইলে তো আগে হাতের বাঁধন খুলতে হবে। সেটা আমার না, মামার দায়িত্ব। আমি মামাকে ডাকলাম, “মামা।”
“কী টোপন?”
“আমি তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি।”
“কী গিফট? একটা নেইল কাটার?”
“না মামা। তোমার পিস্তলটা।”
মামা দেওয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, আমার কথা শুনে হাত বাধা অবস্থায় প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বসে গেল। প্রায় চিৎকার করে বলল, “কী বললি? পিস্তল? আমার পিস্তল?”
“হ্যাঁ মামা।” আমার প্যান্টে গুঁজে রেখেছি। পকেটে এক্সট্রা ম্যাগাজিন।”
“কিন্তু সেইটা ছিল সেফটি বক্সে। পাসওয়ার্ড দেওয়া সেফটি বক্সে।”
“হ্যাঁ মামা।”
“তুই তুই তুই আমার পাসওয়ার্ড জানিস?”
“না জানার কী আছে? তুমি যেভাবে পাসওয়ার্ড ঢোকাও সেইটা জানতে না চাইলেও আমি জেনে যাই।”
মামা খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, “তুই আসলেই একটা মিচকি শয়তান।”
“কিন্তু মামা, তুমি পিস্তলটা ব্যবহার করবে কেমন করে? হাতগুলো যে বাঁধা।”
“হাতের বাঁধা খোলা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু তার আগে তোকে একটা জোক বলতে হবে।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “এখন তুমি জোক বলবে? আগে হাতের বাঁধা খুলে ফেলি।”
“এইটা কী কঠিন? তুই গড়িয়ে গড়িয়ে আমার কাছে আয়। আমার পিছনে তোর হাতগুলো দে, আমি তোর হাত খুলে দেই। তারপর তুই আমারটা খুলে দিবি।”
“এতো সোজা!”
“হ্যাঁ, এত সোজা। শুধু এর মাঝে কেউ চলে না আসলেই হলো।”
আমি তখন গড়িয়ে গড়িয়ে মামার কাছে চলে এসে মামার হাতের কাছে আমার হাতগুলো রাখলাম। মামা আমার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, “এবারে জোকটা শোন। এই মাথা মোটা মানুষগুলোর কাজ কর্ম দেখে আমার জোকটা মনে পড়ল। একবার একটা মানুষের বাসায় চোর এসেছে। মানুষটা চোরটাকে ধরে ফেলে তার খাটের সাথে বেঁধে গেছে থানায়, পুলিশ ডেকে আনতে। পুলিশ জিজ্ঞেস করল চোরটাকে ঠিক করে বেঁধেছ তো? মানুষটা বলল, হ্যাঁ খুব ভালো করে খাটের সাথে চোরের পা টা বেঁধে রেখেছি। পুলিশ চোখ কপালে তুলে বলল, শুধু পা? হাত বাঁধা নাই? মানুষটা, বলল, না হাতটাতো বাঁধি নাই। পুলিশ বলল তাহলে চোরটা এতক্ষণে তার হাত দিয়ে পায়ের বাঁধা খুলে পালিয়ে গেছে। মানুষটা কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, মনে হয় পালায় নাই। চোরটা আমার মতো পাকিস্তানী! আমার মাথায় যখন এই বুদ্ধিটা আসে নাই, চোরের মাথায়ও আসবে না, সে নিশ্চয় পা বাঁধা নিয়ে বসে আছে–” মামা তার জোক শেষ করে হা হা করে হাসতে লাগল। নিজের জোক শুনে কাউকে আমি কখনো এভাবে হাসতে দেখি নাই।
আমিও হাসলাম। মামা হাসি থামিয়ে বলল, এই বিদেশি গুলির বুদ্ধি পাকিস্তানীদের মতো! যখন দুইজন মানুষের হাত বেঁধে একটা ঘরে রাখা হয় তখন তাদের একজন যে আরেকজনের বাঁধা খুলে ফেলতে পারে সেইটা তাদের মাথায় আসে নাই!”
মামা ততক্ষণে আমার হাত খুলে দিয়েছে, আমি হাত দুইটা একটু নাড়লাম তারপর মামার হাতের বাঁধনটা খুলে দিতে দিতে বললাম, “মামা, পাকিস্তানিরা কী আসলেই এত বোকা?”