বাইরে কিছু মানুষের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পেলাম। এবারে মানুষগুলো আর ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে না। তারা চাবি এনে চাবি দিয়ে দরজার তালা খোলার চেষ্টা করছে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, তার মাঝে হঠাৎ করে তালা খুলে ভিতরে কয়েকজন মানুষ ঢুকে গেল। আমি অন্ধকারে তাদের ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে যেতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। মানুষগুলো আমাকে জাপটে ধরে ফেলল, আমি তার ভেতরেই হাতের সিলিন্ডার ঘুরিয়ে কয়েকজনের নাক মুখ মোটামুটি থ্যাতলে দিলাম।
শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে ধরে ফেলল, ঘরের লাইট জ্বালিয়ে তারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি দেখলাম আমার সিলিন্ডারের আঘাতে একজনের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আরেকজনের বাম চোখটা প্রায় বুজে এসেছে।
মানুষগুলো সবই বিদেশি। হড়হড় করে কিছু একটা বলছে, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন দেখলাম একজন বাঙালি মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাছে এসে সে আমাকে দেখে তোতলাতে তোতলাতে বললম, “তু-তু-তুমি? আবার?”
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “হ্যাঁ। আমি আবার।”
“কেন?”
আমি বললাম, “বুঝেন নাই কেন? আমার মামা কোথায়?”
মানুষটা বলল, “তোমার মামা এখানে নাই।” যদি সত্যি আমার মামা এখানে না থাকতো কিংবা মামার কথা না জানতো তাহলে মানুষটা অবাক হয়ে বলতো, মামা? কোন মামা? কার মামা? কিন্তু মানুষটা আমার মামার কথা খুব ভালো করে জানে।
আমি বললাম, “মিথ্যা কথা বলেন কেন? আমার মামাকে ধরে এনেছেন কেন?”
“আমরা তোমার মামাকে ধরে আনব কেন?” মানুষটা তার কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করল কিন্তু কথাটার মাঝে বেশি জোর বোঝা গেল না। বোঝাই গেল সে মিথ্যা কথা বলছে।
আমি বললাম, “আমি বলব কেন আপনারা আমাকে ধরে এনেছেন? বলব?”
মানুষটা মিনমিন করে বলল, “বল।”
“তার কারণ হচ্ছে আপনারা যে থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি বানাচ্ছেন সেটা ভূয়া। পুরোপুরি ভূয়া।”
“ভূয়া?”
“হ্যাঁ। আসলে এটা হচ্ছে একটা ইউরেনিয়ামের খনি।”
এবারে সবগুলো মানুষের চোয়াল এক সাথে ঝুলে পড়ল। আমার একেবারে মনে হলো কটাশ করে একটা শব্দ হলো। আমি এতোক্ষণ বাংলায় যে কথাগুলো বলছিলাম তার কিছুই বিদেশিগুলো বুঝে নাই কিন্তু তারা থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আর ইউরেনিয়াম এই দুটা কথা বুঝতে পারছে এবং এক সাথে সবাই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠেছে।
আমি দেখলাম সবগুলো মানুষের চোয়াল একবার বন্ধ হচ্ছে আরেকবার খুলছে, কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর যে বিদেশিটার চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে সে আমতা আমতা করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, “হাউ ডু ইউ নো?”
আমি মুখের মাঝে খুবই উঁচু ধরনের ভাব ফুটিয়ে বললাম, “গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি।”
মানুষটার চোয়াল আবার ঝুলে পড়ল। বলল, “গা-গা-গা–” পুরো গামা রে স্পেকট্রোস্কাপি বলতে পারল না। আমি মুখে আরো বেশি ভাব ফুটিয়ে বললাম, “সোডিয়াম আয়োডাইড ক্রিস্টাল উইথ ফটোমাল্টিপ্লায়ার।”
মানুষটার চোয়াল এবারে বন্ধ হয়ে গেল। আমি সিনেমার ভিলেনদের মতো মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করলাম, “ইউ ওয়ান্ট দিস সিক্রেট সো ইউ হাইজ্যাক মাই সাইন্টিস মামা।” তোমরা এটা গোপন রাখতে চাও সেইজন্য মামাকে হাইজ্যাক করে এনেছ। ইংরেজিটা পুরোপুরি মনে হয় ঠিক হয় নাই কিন্তু মানুষগুলো আমার কথাগুলো ঠিকই বুঝতে পারল। তাদের লাল মুখ কালো না হয়ে কেমন যেন বেগুনি হয়ে গেল।
এরা নিজেরা নিজেরা কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর বাঙালি মানুষটাকে কিছু একটা বলে মুখ ভোলা করে দাঁড়িয়ে রইল।
বাঙালি মানুষটাকে কেমন যেন নার্ভাস মনে হলো। সে আমার হাত ধরে বলল, “আস।” তার ঠিক পিছনে লাল মুখের একটা মানুষ বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভঙ্গীটা খুবই স্পষ্ট, আমি যদি একটু খানি উল্টাপাল্টা কিছু করি তাহলে সে আমার মাথাটা টেনে ধর থেকে আলাদা করে ফেলবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”
“সব কথা তোমাকে বলতে হবে কেন?”
“কারণ আপনি তো বিদেশি না–আপনি এই দেশের।”
“তাতে কী হয়েছে?”
“বিদেশিদের পা চাটতে হয় না। খুব লজ্জার ব্যাপার।”
আমার কথা শুনে মানুষটা কেমন যেন লাল হয়ে উঠে। লজ্জায় না রাগে বুঝতে পারলাম না।
আমি ইচ্ছা করলেই ঝটকা মেরে নিজের হাত ছুটিয়ে নিতে পারি। পাহাড়ের মতো মানুষটার অসুবিধার জায়গায় যেভাবে কষে একটা লাথি দিয়েছিলাম ঠিক সেভাবে এই মানুষটাকেও অচল করে দিতে পারি। ঠিক কী কারণ জানি না হঠাৎ করে আমার সব ভয় ডর চলে গেছে, আমার মনে হতে থাকে যে এই মুহূর্তে কিছু করার দরকার নাই। দেখি কী করে। আমি এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। মনে হয় পেটের কাছে প্যান্টের ভিতর মামার পিস্তলটা খুঁজে রেখেছি সেইজন্য। শুধু তাই না পকেটে বুলেট ভরা একটা ম্যাগাজিনও আছে। সাথে পিস্তল আর বুলেট থাকলে মনে হয় ভয়। লাগে না।
বাঙালি মানুষটা আমাকে টেনে নিতে থাকে, পিছন পিছন লাল মুখের মানুষটা থপ থপ করে পা ফেলে ফেলে আসতে থাকে। হেঁটে হেঁটে একটা ঘুরে ঢুকে সেখানে একটা আলমারির সামনে মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল। তখন লাল মুখের মানুষটা ধাক্কা দিয়ে আলমারিটা সরাতেই পিছনে একটা দরজা দেখা গেল। বাঙালি মানুষটা দরজা খুলে আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ঘরের ভিতর দেওয়ালে হেলান দিয়ে একজন মানুষ বসে আছে, মানুষটির চেহারা না দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, এটি আমার মামা।