“ঠিক আছে।”
“যাও তাহলে। ডোরিন তোমার আব্বুকে ভালো করে বুঝিও।”
“বোঝাব। টোপন, তুমি চিন্তা করো না।”
ডোরিন আর টনি চলে যাবার পর আমি আর মাহবুব একা একা কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তারপর মাইক্রোবাসের চারপাশটা ভালো করে খুঁজে দেখলাম। মনে হয় মাটিতে একটু ধস্তাধস্তির চিহ্ন আছে। কাল রাতে যে রকম সিগারেটের গোড়া পেয়েছিলাম, আজকেও সেরকম কয়েকটা সিগারেটের গোড়া দেখলাম, একটু দূরে মনে হলো গাড়ির টায়ারের দাগও আছে।
আমরা আবার মাইক্রোবাসে ফিরে এলাম। ভেতরে যেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো একটু গুছিয়ে রাখলাম। তখন মনে হলো শুধু শুধু বসে না থেকে আমরা যে মাটিটা এনেছি সেটা গামা রে স্পেকট্রোমিটারে বসিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করি। মামা যখন শিখিয়ে দিয়েছিল তখন পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। আমার ডাইরিতেও লিখে রেখেছিলাম। নিজে নিজে এটা করব কখনো ভাবিনি, তাহলে আরেকটু ভালো করে শিখে নিতাম।
আমি আমার ব্যাকপেক বোঝাই মাটিটা গামা রে স্পেকট্রোমিটারে সোডিয়াম আয়োডাইড ক্রিস্টালের চারপাশের খালি জায়গাটাতে ঢেলে দিলাম। ডাইরিতে লেখা আছে এর পরে ডিসপ্লেটা অন করতে হবে। আমি ডিসপ্লে অন করতেই চ্যানেল নম্বর আর কাউন্টস দেখা যেতে লাগল। আমি এগুলো শুধু তোতা পাখির মতো মুখস্ত করে রেখেছি কোনটার কী অর্থ কিন্তু জানি না। এরপর ফটো মাল্টিপ্লায়ারের হাই ভোল্টেজ আস্তে আস্তে বাড়াতে লাগলাম সাথে সাথে কাউন্ট দেখা যেতে লাগল। আমি আস্তে আস্তে ভোল্টেজ বাড়িয়ে যতটুকু করা দরকার ততটুকু করে দিলাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম কুটকুট করে কাউন্ট বাড়তে থাকে এবং বেশ কয়েকটা পিক বের হয়ে আসছে। মামা যখন আমাকে শিখিয়েছিল তখন অনেকক্ষণ কাউন্ট নেওয়ার পর একটুখানি করে কাউন্ট জমা হতো। এখন কতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে।
মাহবুব আমার পাশে বসে আমি কী করছি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী?”
“আমি জানি না।”
“তাহলে তুমি কী করছ?”।
“সেটাও জানি না। আমি গাড়ির দেওয়ালে স্কচ টেপ দিয়ে লাগানো একটা কাগজকে দেখিয়ে বললাম, “এই কাগজটাতে ইউরেনিয়াম খনি থেকে কী রকম স্পেকট্রাম হওয়ার কথা সেটা দেখানো আছে। আমাদের সিগন্যালটা যদি এরকম হয় তাহলে বুঝতে হবে এখানেও ইউরেনিয়াম আছে।”
মাহবুব কাগজে প্রিন্ট করা সিগন্যাল আর আমাদের ডিসপ্লের সিগন্যালটা মিলিয়ে দেখল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “মিল আছে।”
“ক্যালিব্রেশান করা হয় নাই। ক্যালিব্রেশান করলে আরো মিল হবে।”
“ক্যালিব্রেশান মানে কী?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “জানি না।”
মাহবুব অবাক হয়ে বলল, “জান না তাহলে বলছ কেমন করে?”
“সেইটাও জানি না।”
মাহবুব আর কিছু বলল না। আমি বললাম, “এখন কয়েক ঘন্টা ডাটা নিলে স্পেকট্রামটা সুন্দর হবে।”
কাজেই আমরা কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকলাম।
ধীরে ধীরে দুপুর হয়ে গেল, এখনো মামার কোনো দেখা নেই। ডোরিন তার আব্বুকে ঠিকমতো বুঝিয়েছে কিনা কে জানে। তার আব্বু কী পুলিশকে ডাকিয়েছে? পুলিশ কী এসে নিচে ল্যাবরেটরিতে গিয়েছে? মামা কী সেখানে আছে? যদি মামাকে খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে কী হবে? বাসায় ফোন করে আব্বু আম্মুকে জানাতে হবে। কী জানাব? আব্বু আম্মুকে কী বলব আমি?”
দুপুর বেলার দিকে মাহবুব বলল, “আমাদের এখন কিছু খাওয়া দরকার।”
আমি বললাম, “ঠিকই বলেছ। খিদে লেগেছে। মানুষের শরীর খুবই আশ্চর্য, এতো বিপদের মাঝেও খিদে পেয়ে যাচ্ছে। আমি খুঁজে খুঁজে কয়েকটা নুডলসের প্যাকেট বের করলাম। একটা বাটির মাঝে পানি ঢেলে সেখানে নুডলসগুলো ভেঙে দিলাম, দুটি ডিমও ভেঙে সেখানে দিলাম, তারপর সবকিছু মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে সেটা পাঁচ মিনিটের জন্য চালিয়ে দিলাম। পাঁচ মিনিট পর মাইক্রোওয়েভ ওভেন খুলে দেখলাম নুডলসগুলো এখনো সিদ্ধ হয়নি। তখন সেগুলো আরও পাঁচ মিনিটের জন্য দিয়ে দিলাম। এভাবে বেশ কয়েকবার চালানোর পর মনে হলো নুডলসগুলো সিদ্ধ হয়েছে। তবে দেখতে খুবই ভয়ংকর।
তখন আমি আর মাহবুব দুইটা চা চামচ নিয়ে নুডলসগুলো খেতে শুরু। করলাম। পুরো জিনিসটা দেখতে যত ভয়ংকর হয়েছে খেতে কিন্তু তত খারাপ হয়নি। কিংবা কে জানে হয়তো বেশি খিদে লাগলে সবকিছুই খেতে ভালো লাগে। খাওয়া শেষ করার পর আমরা বাটি এবং চামচ ধুয়ে রেখে দিয়ে আবার অপেক্ষা করতে থাকি।
গামা রে স্পেকট্রোমিটারে সিগন্যালগুলো আস্তে আস্তে বেড়েছে। বেশ পরিষ্কার কয়েকটা পিক দেখা যাচ্ছে। মামা দেখলেই এই পিকগুলো চিনে ফেলতো। আমি কিছুই চিনলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম সিগন্যালটা দেখতে গাড়ির দেওয়ালের কাগজের প্রিন্টটার মতো। সেটাই অনেক বড় ব্যাপার।
বাইরে যখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে তখন আমি কাউন্ট বন্ধ করে স্পেকট্রোমিটার একটা প্রিন্ট নিয়ে নিলাম। খুবই সুন্দর প্রিন্ট। মামা আমার কাজ দেখলে খুশি হতো। কিন্তু মামা নেই। আমি প্রিন্টটা আমার ডাইরিতে স্কচটেপ দিয়ে লাগিয়ে নিলাম। কোথায় আছে কে জানে। বেঁচে আছে কিনা সেটাই বা কে জানে। চিন্তা করেই আমার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। মনে হলো হাউ মাউ করে কাঁদি।
ঠিক এরকম সময় আমি একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেলাম। একটু পরে গাড়ির হেড লাইটের আলোতে জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠল।