“প্রবেশ নিষেধ? ডোরিন যেন রীতিমতো আকাশ থেকে পড়ল। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকালো, রীতিমতো অনবদ্য অভিনয়, বলল, শুনেছ? এখানে নাকি প্রবেশ নিষেধ?”
আমি ব্যাকপেকটা ঘাড়ে নিয়ে বললাম, “কোথাও তো লেখা নাই প্রবেশ নিষেধ। বুঝব কেমন করে?”
মানুষটা হাত নেড়ে বলল, “এতো বড় সাইন বোর্ড, দেখ নাই?”
“সাইনবোর্ডে প্রবেশ নিষেধ লেখা নাই।”
“আছে।”
“নাই। লেখা আছে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।”
“একই কথা।”
মাহবুব বলল, “এক কথা না। প্রবেশ অধিকার সংরক্ষিত মানে কেউ কেউ আসতে পারবে।”
ডোরিন আবার মধুর ভঙ্গীতে হাসার ভঙ্গী করে বলল, “মনে করেন আমরা হচ্ছি সেই কেউ কেউ।”
গার্ড মানুষটা কী করবে বুঝতে না পেরে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ব্যাগে কী ঢুকাচ্ছিলে?”
“কিছু ঢুকাচ্ছিলাম না।”
“আমি দেখেছি তুমি কী যেন ঢুকাচ্ছ।”
আমি আবার ব্যাগের দিকে তাকালাম, তারপর হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গী করে বললাম, “ও আচ্ছা! এগুলো! কয়েকটা গাছের চারা নিয়েছি। এগুলো হচ্ছে রাজাকার গাছের চারা।”
“কিসের চারা?”
“রাজাকার গাছ। সেভেন্টি ওয়ানে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, কোনো কাজে লাগে না শুধু কাটা। সেইজন্য বলে রাজাকার গাছ।”
“কী করবে এই গাছ দিয়ে?”
“স্কুলে দেখাব। সায়েন্স প্রজেক্ট।”
আলাপটা কোনদিকে যাবে বোঝা যাচ্ছিল না তাই ডোরিন তার মতো করে শেষ করার চেষ্টা করল, বলল, “আংকেল, আপনার সাথে একটা পিক তুলতে পারি?” ছবিকে কখন পিক বলতে হয় ডোরিন সেটা খুব ভালো করে জানে।
মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, “আমার সাথে? পিক?”
“হ্যাঁ। আপনি বন্দুকটা এইম করে ধরবেন।”
“এইটা বন্দুক না। এইটাকে বলে রাইফেল।”
“ও আচ্ছা! আপনি রাইফেলটা এইম করে ধরবেন, আমরা দুই পাশে দাঁড়াব।”
গার্ড মানুষটা ছবি তোলার কথা শুনে মনে হয় একটু নরম হয়ে গেল। বলল, “ঠিক আছে। তুলতে চাইলে তুলো। তারপর তাড়াতাড়ি চলে যাও। বড় স্যার দেখলে অনেক ঝামেলা হতে পারে।”
কাজেই বড় স্যার দেখার আগেই আমরা কয়েকটা ছবি তুলে নৌকায় ফিরে এলাম। নৌকাটা মাঝ নদীতে নেওয়ার পর আমি গাইগার কাউন্টারটা ব্যাকপেক বোঝাই মাটির কাছে আনার সাথে সাথে সেটা বিকট স্বরে কট কট শব্দ করতে থাকে। আমি দাঁত বের করে বললাম, “মামা আজকে কী অবাক হবে আর কী খুশি হবে চিন্তা করতে পার?”
সবাই স্বীকার করল তারা সেটা চিন্তা করতে পারে না।
দূর থেকে মামার মাইক্রোবাসটা দেখেই আমার বুকটা কেমন জানি ছাৎ করে উঠল। ঠিক কেন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আমি নিজেও জানি না। ড্রাইভিং সীটের একটা দরজা খোলা ছিল এছাড়া আর কিছুই অস্বাভাবিক ছিল না।
আমি মাইক্রোবাসটার কাছে গিয়ে মামাকে ডাকলাম, “মামা।”
কেউ আমার কথার উত্তর দিল না। আমি আবার ডাকলাম এবারেও কেউ আমার কথার উত্তর দিল না। আমার কাছে মাইক্রোবাসের একটা চাবি তাকে, আমি সেটা বের করে মাইক্রোবাসের পিছনের দরজা খুলে ভিতরে উঁকি দিলাম। ভিতরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কিন্তু মামার কোনো চিহ্ন নাই। মামার এক পাটি জুতা শুধু পড়ে আছে। এক পাটি জুতার মতো ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না। এক পাটি জুতা দেখলেই বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে উঠে। কিছু একটা অস্বাভাবিক না হলে কখনোই এক পাটি জুতা পড়ে থাকে না।
আমি আবার গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, “মামা। মামা।”
কেউ উত্তর দিল না, উত্তর দেবে আমি সেটা আশাও করি নাই, ভয়ে আমার বুকটা হিম হয়ে গেল।
মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? তোমার মামা কোথায়?”
আমি শুকনো গলায় বললাম, “মনে হয় ওই বদমাইশগুলো ধরে নিয়ে গেছে।”
ডোরিন অবাক হয়ে বলল, “ধরে নিয়ে গেছে? কিডন্যাপ?”
“মনে হয়। রাত্রি বেলা এরা মাইক্রোবাসটার চারপাশে হাঁটাহাঁটি করছিল।”
“সর্বনাশ! এখন কী হবে?”
টনি জিজ্ঞেস করল, “ধরে কোথায় নিয়ে গেছে?”
“নিশ্চয়ই মনি কাঞ্চনের নিচতলায়। গোপন ল্যাবরেটরিতে।”
“কিন্তু সেইটা তো আর গোপন না, আমরা তো সেইটার কথা জেনে গেছি।”
আমি ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা করে বললাম, “আমাদের এখন সেই গোপন ল্যাবরেটরিতে গিয়ে খুঁজতে হবে। মামাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
ডোরিন মাথা নাড়ল, বলল, “না না। আমাদের খুঁজতে হবে কেন? পুলিশ গিয়ে খুঁজবে। আমরা এক্ষুণি আমার আব্বুর কাছে গিয়ে সব কিছু বলব। আব্বু তখন পুলিশকে ফোন করে দিবে। পুলিশ এসে খুঁজবে।”
মাহবুব মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ আমাদের ছোটদের কথা কেউ শুনবে না। একজন বড় মানুষকে কথা বলতে হবে।”
ডোরিন বলল, “আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। চল সবাই।”
আমি বললাম, “আমি এখানে থাকি। যদি মামা হঠাৎ চলে আসে।”
মাহবুব বলল, “টোপনের একা থাকা ঠিক হবে না, আমি টোপনের সাথে থাকি।”
ডোরিন বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমি আর টনি যাচ্ছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না টোপন। টনি আর আমরা যাই।”
আমি বললাম, “শুধু একটা জিনিস।”
“কী”
“ইউরেনিয়ামের খনির কথাটা সোজাসুজি বলে দিও না।”
“তাহলে কী বলব।”
“জানি না। আমার মাথা কাজ করছে না, চিন্তা করে কিছু একটা বলে দিও।”
“ঠিক আছে।”
“আরেকটা ব্যাপার।”
‘কী?”
“আমরা যে মনি কাঞ্চনের পিছনে গোপন সিঁড়িটা পেয়েছি সেটার কথাও বলো না। এটা আমাদের কাছে গোপন থাকুক। যদি কাজে লাগে।”