ডোরিন আর টনির আসতে বেশ দেরী হলো। স্পিডবোটটা আগের মতো তাদেরকে নদীটার গোড়ায় নামিয়ে দিয়েছে। আমি দেখলাম তাদের দুজনের মুখ একটু গম্ভীর। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই ডোরিন বলল, মনি কাঞ্চন থেকে তাদের জানিয়েছে যে তাদের রিসোর্টে নাকি আজকের পর আর বুকিং নেই। আগে কখনো এরকম হয়নি তারা যতদিন ইচ্ছা থেকেছে। আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম, আমরা তাদের গোপন ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেছি নিশ্চয়ই সেজন্য বদমাইশগুলো ডোরিনদের বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে।
টনি মুখ শক্ত করে বলল, “যাওয়ার আগে মনি কাঞ্চনে আগুন দিয়ে যাব।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “গুড আইডিয়া তাহলে এটা আর মনি কাঞ্চন না থেকে ছাই ভস্ম হয়ে যাবে।”
ডোরিন হি হি করে হাসল, বলল, “রিসোর্ট ছাই ভস্ম নামটা খারাপ না।”
মাহবুব বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল যাই।”
ডোরিন বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও। রওনা দেওয়ার আগে আমরা একটা সেলফি তুলে নিই।”
“সেলফি তুলবে? ক্যামেরা আছে?”
“আম্মুকে বলে তার মোবাইলটা নিয়ে এসেছি। ফিরে যাওয়ার সময় ফোন করার জন্য।”
আমরা নদীর তীরে চারজন দাঁড়ালাম। ডোরিন আমাদের চারজনের একটা সেলফি তুলল। প্রথমে স্বাভাবিক ভঙ্গী, তারপর দাঁত বের করে সবশেষে দুই আঙুল তুলে বিজয়ের ভি সাইন দেখিয়ে। বিজয়টা ঠিক কোথায় সেটা অবশ্য পরিষ্কার বোঝা গেল না।
নদীর তীর ধরে অনেকক্ষণ হেঁটে আমরা শেষ পর্যন্ত মাহবুবের নৌকাটা পেলাম। মাহবুব পানিতে নেমে নৌকাটাকে ঠেলে যতদূর সম্ভব তীরের কাছে নিয়ে এলো। আমরা জুতা খুলে পানিতে হেঁটে নৌকায় উঠে গেলাম।
মাহবুব লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটাকে সামনে নিতে থাকে। আমিও আরেকটা লগি দিয়ে মাহবুবকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতে মাহবুবের কতোটুকু সাহায্য হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু পর। নৌকাটা নদীর একটু গভীরে যাওয়ার পর মাহবুব লগি রেখে বৈঠা তুলে নিল। সে হাল ধরল, আমরা তিনজন বৈঠা বাইতে লাগলাম, দেখতে দেখতে আমাদের নৌকা গুলির মতো ছুটতে লাগল। আমরা হেইয়া হো হেইয়া হো করে চিৎকার করতে করতে বৈঠা বাইছি। তার মাঝে ডোরিন একটু পর পর তার আম্মুর মোবাইলে ছবি তুলতে লাগল।
মাহবুব একসময় হাত তুলে আমাদের থামাল। বলল, আমরা ইউরেনিয়াম খনির কাছাকাছি চলে এসেছি। আসলেই এটা ইউরেনিয়াম খনি কিনা আমরা জানি না কিন্তু সবাই জায়গাটাকে ইউরেনিয়াম খনি বলছি।
আমরা সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম হাতের বামপাশে একটা বড় জায়গা কাটা তার দিয়ে ঘেরাও করা। এক পাশে বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা :
থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য নির্ধারিত স্থান
প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত
আমি আমার ব্যাকপেক থেকে গাইগার কাউন্টারটা বের করে সেটা জায়গাটার দিকে মুখ করে ধরে অন করলাম গাইগার কাউন্টারের কটকট শব্দ তুলনামূলকভাবে বেশি কিন্তু খুব বেশি তা নয়।
মাহবুব বলল, “আমরা এখানে নামব না। এখানে কয়েকটা গার্ড ঘোরাঘুরি করছে। আরো ভেতরে যাই।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে।”
তারপর আবার সবাই মিলে বৈঠা বাইতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণের মাঝে একটা নির্জন জায়গায় পৌঁছালাম। এখানে নদীর তীরে বেশ কিছু ঝোঁপঝাড় আছে। কাঁটাতারের বেড়াটা নেই। আমরা নৌকা থামিয়ে নেমে যেতে পারব। আমি আবার গাইগার কাউন্টার বের করে পরীক্ষা করলাম। কটকট শব্দটা যথেষ্ট বেশি। সেটা হাতে নিয়ে আমি প্রথমে নৌকা থেকে নামলাম। আমার পিছু পিছু ডোরিন আর টনি এবং সবার শেষে মাহবুব নৌকা থেকে নেমে এলো।
আমি বললাম, “যদি গার্ড চলে আসে আমরা ভান করব যে আমরা জানতাম না এখানে ঢোকা নিষেধ। যদি আমাদের মাটি তুলতে না দেয় তাহলে সবাই জুতার ভেতরে মাটি ভরে নিয়ে যাবো।”
টনি অবাক হয়ে বলল, “জুতার ভিতরে?”
“হ্যাঁ, পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ে যতটুকু পার জুতার মাঝে ভরবে।”
আমরা তখন খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গী করে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে থাকি এবং হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার গাইগার কাউন্টারটা আগের মতো অনেক বেশি কট কট শব্দ করতে শুরু করেছে। জায়গাটা সত্যিই রেডিও একটিভ মাটি দিয়ে বোঝাই।
আমি আশে পাশে তাকিয়ে ব্যাকপেকটা নামিয়ে হাতের খুরপিটা দিয়ে মাটি খুঁড়ে ব্যাগে ভরতে থাকলাম। ডোরিন টনি আর মাহবুব আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল যেন কেউ আমাকে দেখতে না পায়।
আমি যখন মাটি তুলে আমার ব্যাকপেকটা প্রায় ভরে ফেলেছি তখন হঠাৎ দেখলাম একজন গার্ড একটা বন্দুক হাতে হাত নাড়তে নাড়তে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে।
ডোরিন সাথে সাথে তার ক্যামেরাটা বের করে সেলফি তোলার ভান করতে লাগল। আমি দ্রুত কয়েকটা আগাছা ধরনের গাছ টেনে তুলে ব্যাকপেকে ভরে ফেললাম। মাটি কেন নিয়েছি জানতে চাইলে বলব মাটি নয়, গাছের চারা নিচ্ছি। এবং গাছের চারার সাথে একটু মাটি না থাকলে গাছের চারা বাঁচে না।
গার্ডটা হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের কাছে এসে তার বন্দুকটা রীতিমতো আমাদের দিকে তাক করে ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা কে? এখানে কী করতে এসেছ?”
ডোরিন মধুর একটা ভঙ্গী করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “কেন? আমরা বেড়াতে এসেছি! কী সুন্দর এই জায়গাটা।”
গার্ড গলার স্বর আরো উঁচু করে বলল, “এটা কী বেড়ানোর জায়গা? দেখো নাই এখানে প্রবেশ নিষেধ?”