মামা বলল, “না দুলাভাই ভয়ের কিছু নাই। আমাকে কেউ কিছু করবে না। আমি যখনই কোথাও যাই লোকাল অথরিটি সেটা জানে। আমাকে প্রটেকশন দেয়। আমি নিজেও রেডি থাকি।”
“তুমি কীভাবে রেডি থাক?”
মামা এবারে পিছনে ফিরে আমার দিকে তাকাল, আমি তাদের কথা শুনছি কি না সেটা লক্ষ করল। আমি তখন বইয়ের দিকে আরো বেশি নজর দিয়ে চেহারার মাঝে একটা ভ্যাবলা ভাব ফুটিয়ে একেবারে শুয়ে পড়ার ভান করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।
মামা গলা নামিয়ে বলল, “আমি সবসময় সাথে একটা হ্যান্ডগান। রাখি।” এবারে কথাটা শুনতে একটু কষ্ট হলো তারপরও শুনতে পেলাম।
আব্বু গলা নামিয়ে বললেন, “হ্যান্ড গান? মানে রিভলবার?”
“পিস্তল।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “রিভলবার আর পিস্তলে পার্থক্য কী?”
মামা গলা নামিয়ে বলল, “রিভলবারে গুলির ম্যাগাজিনটা রিভলব করে, মানে ঘুরে। পিস্তলে ম্যাগাজিন আলাদা।”
আম্মু ভয়ে ভয়ে বলল, “সর্বনাশ! তুই অস্ত্র নিয়ে ঘুরিস, সন্ত্রাসীদের মতো?”
মামা হাসল, বলল, “সন্ত্রাসী হব কেন? লাইসেন্স করা হ্যান্ডগান। নিজের প্রটেকশনের জন্য রাখি।”
“কোথায় রাখিস?”
“আছে আমার সাথে।”
আম্মু বললেন, “দেখি।”
মামা এবং আব্বু আম্মু আবার পিছনে ফিরে দেখলেন আমি কী করছি। আমি এবারে প্রায় গড়িয়ে পড়ার ভান করে বইয়ে আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে চোখের কোণা দিয়ে তাকালাম। সরাসরি না তাকিয়েও যে চোখের কোণা দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার দেখা সম্ভব বড় মানুষেরা সেটা জানে না দেখে আমি খুবই অবাক হলাম! মানুষের জন্মের সময় মাথা ভরা বুদ্ধি থাকে, যতই বড় হয় সেই বুদ্ধি উড়ে উড়ে মানুষ বোকা হতে থাকে। যত বড় তত বোকা!
স্পষ্ট দেখলাম মামা খুব সাবধানে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের নিচে কোথা থেকে একটা কালো রংয়ের পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল। কী অসাধারণ একটা পিস্তল। ইশ! আমার যদি এরকম একটা পিস্তল থাকতো! এতোদিন মামাকে সায়েন্টিস্ট হিসেবে কোনো পাত্তা দেই নাই, সবসময়ই মনে হয়েছে অকাজের একটা মানুষ। কিন্তু যে মানুষ বগলের কাছে একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে তার থেকে অসাধারণ মানুষ আর কে হতে পারে? একেবারে সিনেমার নায়কের মতো।
আম্মু ফিসফিস করে বললেন, “গুলি বের হয়ে যাবে না তো।”
মামা বলল, “না, সেফটি ক্যাচ অন করা আছে।”
“কয়টা গুলি আছে?”
“আটটা।”
মামা মনে হয় পিস্তলটা খুলে গুলি বের করে দেখাল।
এবারে আব্বু ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন, এতো আস্তে বললেন যে আমি শুনতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম এখন আমার আবার কথা বলা দরকার। হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসে বইটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আম্মু! আব্বু!
মামা তখন রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার পিস্তলটা দুই হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কী নিয়ে কথা বলছ?”
আম্মু শক্ত গলায় বললেন, “আমরা যেটা ইচ্ছা সেটা নিয়ে কথা বলব। তোর সমস্যাটা কী?”
“না। সমস্যা নাই। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“তোমরা এতো ফিসফিস করে কথা বলছ তাই জানতে চাচ্ছিলাম কী নিয়ে কথা বলছ।”
আব্বু বললেন, “টোপন, তোর বড়দের কথা জানার কোনো দরকার নাই। যা, অন্যদের সাথে খেল গিয়ে।”
কাজেই আমি মুখে চরম একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বইটা হাতে নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বের হয়ে এলাম। বের হয়ে শুনলাম আম্মু আমাকে নিয়ে কোনো একটা মন্তব্য করলেন। কী মন্তব্য করলেন বুঝতে পারলাম না শুধু নিজের নামটা শুনতে পেলাম।
আমার নাম হচ্ছে টোপন। পৃথিবীতে নাকি সাতশ কোটি মানুষ, সাতশ কোটি মানুষের সাতশ কোটি নাম। এই সাতশ কোটি মানুষের সাতশ কোটি নামের ভিতরে খুঁজে খুঁজে আমার আব্বু আম্মু আমার জন্য এর থেকে ভালো কোনো নাম খুঁজে পেল না? টোপন একটা নাম হলো? যতদিন ছোট আছি টোপন নামটা সহ্য করা যায়। যখন বড় হব তখন যদি কেউ এই নামটা জেনে যায় তখন কী হবে?
আমি ঠিক করেছি মরে গেলেও বিয়ে করব না। (মানুষ কেমন করে বিয়ে করে কে জানে?) ভাগ্যিস কোনোদিন বিয়ে করব না, যদি করতাম তাহলে আমার ছেলে মেয়ে হতো, তারা জানতো তাদের বাবার নাম হচ্ছে টোপন। কী লজ্জার একটা ব্যাপার হতো।
.
আমি বিয়ে না করলেই যে বিপদ কেটে যাবে সেটা পুরোপুরি ঠিক না। আমার একটা বোন আছে, নাম রত্না এবং একটা ভাই আছে নাম মিঠুন তারা নিশ্চয়ই বিয়ে করে ফেলবে। তাদের নিশ্চয়ই বাচ্চা কাচ্চা হবে সেই বাচ্চা কাচ্চারা আমাকে হয় টোপন মামা নাহলে টোপন চাচা ডাকবে। যদি একটু নেকু টাইপ হয় তাহলে হয়তো টোপন চাচ্চু ডাকবে কী ভয়ংকর শোনাবে। সর্বনাশ!
যাই হোক এগুলো নিয়ে পরে দুশ্চিন্তা করা যাবে, আমি আপাতত বসার ঘরে ঢুকলাম। আপু সামনে টেবিলে পা তুলে সোফায় বসে আছে। আমি যদি কখনো টেবিলে পা তুলে বসি আপু মুখ শক্ত করে বলে, ‘এই টোপন। পা নামিয়ে বস। আপুর অবশ্যি মুখ শক্ত করতে বেশি কষ্ট করতে হয় না, এমনিতেই তার মুখটা শক্ত, দেখে মনে হয় পেট ব্যথা করছে না হয় কান পেকেছে। আমি ভাবলাম একবার বলি, “আপু পা নামিয়ে বস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললাম না। বড় বোনদের কারণে এমনিতেই ছোট ভাইদের জীবনে কতো রকম যন্ত্রণা, এই যন্ত্রণার মাঝে নূতন করে আগুন জ্বালিয়ে লাভ নাই। কিন্তু আরেকটা ইন্টারেস্টিং কাজ করা যায়!