“এই রকম বড় বড় হোটেল রিসোর্টে কাটা চামুচ দিয়ে কিভাবে খেতে হয় জানি না তো“।
ডোরিন বলল, “তুমি কী ভেবেছ আমি ওসব জানি? আর হোটেলে এইগুলো কেউ মানে? দুই হাতে খাবলা দিয়ে গপ গপ করে খাব।”
মামা বলল, “আমি সব নিয়ম জানি। আমি শিখিয়ে দেব। একবার নিয়ম জানা থাকলে যত খুশি ভাঙতে পারবে। আধুনিক কবিতার মতো।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আধুনিক কবিতার মতো। খাওয়ার সাথে কবিতার কী সম্পর্ক?”
“তুই যদি ছন্দ দিয়ে কবিতা লিখতে পারিস শুধু তাহলেই ছন্দ ভেঙ্গে আধুনিক কবিতা লিখতে পারবি।”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি সায়েন্টিস্ট”
মামা গরম হয়ে বলল, “সায়েন্টিস্ট হলে সে দুনিয়ার অন্য কিছু জানতে পারবে না?”
আমি আর কিছু বললাম না। বড় মানুষদের সাথে যুক্তি দিয়ে কথা বলার কোনো উপায় নাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা কেমন করে যাব, মামা?”
“এই মাইক্রোবাসেই চলে যাই।”
এবারে অন্য সবাই আনন্দে হাততালি দিল।
মাহবুব মাইক্রোবাসের সামনে মামার পাশে বসল, তার নাকি বিজ্ঞান, নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। আমরা বাকী তিনজন পিছনে ঢুকে গেলাম। কাজেই আমাকে একা পাওয়া গেল না। কিছু বলতেও পারলাম না।
সত্যিকারের রাস্তায় ওঠার আগে আমরা উঁচু নিচু জায়গা দিয়ে গাড়ির ভেতর উলট পালট খেতে খেতে যেতে লাগলাম। সত্যিকারের সিটে বসে এ রকম রাস্তায় মোটামুটি যাওয়া যায়, কিন্তু এখানে আমরা মাইক্রোবাসের ভিতরে উলট পালট হতে লাগলাম। সত্যি কথা বলতে কী তিনজন মিলে চিৎকার করে আহা উঁহু করে এমন অবস্থা করলাম যে মামা কয়েকবার তার মাইক্রোবাস থামিয়ে আমাদের খবর নিতে নেমে এলো। আমরা তখন বললাম যে আমাদের আসলে সেরকম কোনো সমস্যা নেই, চিৎকার দিতে আনন্দ হয় সেইজন্য চিৎকার দিচ্ছি। মামা ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল বলে মনে হলো না। ধরতে না পারলে নাই, বড় মানুষদের কোনো কিছু সহজে বোঝানো যায় না, শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
সত্যিকারের রাস্তায় উঠার পর কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা মনি কাঞ্চন পৌঁছে গেলাম। গেটে আমাদের থামাল, মামার সাথে কথা বলল, লাঠির আগায় লাগানো আয়না দিয়ে গাড়ির নিচে দেখল, গাড়ির ভিতরে উঁকি দিল এবং রীতিমতো চমকে উঠল। তখন বার মামার সাথে কথা বলল, কোথায় জানি ফোন করল তখন আরো একজন মানুষ নেমে এলো, সে আবার মামার সাথে কথা বলল, তখন শেষ পর্যন্ত আমাদের ঢুকতে দিল।
মামা পার্কিং লটে তার মাইক্রোবাস পার্ক করে আমাদেরকে নিয়ে মনি কাঞ্চনের বড় গেট দিয়ে ভিতরে রওনা দিল। সেখানে মেটাল ডিটেকটর লাগানো গেট দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। আমি একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম, মামার পিস্তলটা নিয়ে নাকি আবার কোনো ঝামেলা হয়। কোনো ঝামেলা হলো না। মামা নিশ্চয়ই তার পিস্তলটা মাইক্রোবাসে রেখে এসেছে। পিস্তল রাখার জন্য মাইক্রোবাসে একটা গোপন বাক্স আছে। এটা খুলতে পাসওয়ার্ড লাগে, মামা জানে না, আমি গোপনে পাসওয়ার্ডটাও বের করে ফেলেছি।
লবিতে ডোরিন আর টনির আব্বু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, আমাদের দেখে এগিয়ে এল। ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী খবর? তোমাদের এডভেঞ্চার কেমন হলো?”
ডোরিন বলল, “তুমি চিন্তা করতে পারবে না আমরা কতো মজা করেছি।”
“দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যাও বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসো।” আমাকে আর মাহবুবকে দেখিয়ে বলল, “তোমাদের বন্ধুদের নিয়ে যাও।”
কাজেই ডোরিন আর টনির সাথে আমরা লিফটে করে উপরে উঠে গেলাম। ডোরিন আর টনি তাদের আব্বু আম্মুকে নিয়ে যেখানে আছে সেটা রীতিমতো একটা বাসা। অনেকগুলি বেড রুম, বড় একটা লিভিং রুম, অনেকগুলো বাথরুম। না জানি এই রুমগুলোর ভাড়া কতো হাজার টাকা।
লিভিং রুমের ভিতর টনির বিখ্যাত কাদের মামা এবং তাদের মায়ের সাথে দেখা হলো। কাদের মামার চেহারাটা যেরকম কল্পনা করেছিলাম ঠিক সেরকম। মাথার চুল কম, অল্প যে কয়টা চুল আছে সেটা সারা মাথায় ল্যাপটে রাখা হয়েছে, নাকের নিচে নবাব সিরাজদ্দৌলার মতো গোঁফ, যখন মুখ খুলেছে দেখলাম পান খেয়ে তার দাঁত তরমুজের বিচির মতো কালো। ডোরিন আর টনির আম্মু ফর্সা গোলগাল, এবং হাসিখুশি। বড়লোক মহিলাদের চেহারা যেরকম হয়।
আমাদের দেখে ডোরিনের আম্মু বলল, “তোমরা এসেছ শেষ পর্যন্ত? আমি তো দুশ্চিন্তাই করতে শুরু করেছিলাম। যদিও তার চেহারা এবং গলায় দুশ্চিন্তার কোনো চিহ্ন ছিল না।
ডোরিন বলল, “না আম্মু, আমাদের সাথে মাহবুব আর টোপন ছিল, তারা সব সময় আমাদের দেখে শুনে রেখেছে।”
“ভেরি গুড।” তারপর আমাদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চারা, তোমরা দেখো আমার এই ছেলে মেয়ে দুজনকে একটু রিয়েল লাইফের এক্সপোজার দিতে পার কিনা। এরা বড়লোকের বাচ্চাদের মতো চব্বিশ ঘণ্টা প্রটেক্টেড লাইফে থাকে। আমি ভাবছিলাম একটু মাঠে ঘাটে ঘুরাঘুরি করে দেখুক সত্যিকারের লাইফটা কী রকম। কোনো কিছু বুঝে সুঝে না একটু দেখে শুনে রেখো
ডোরিন চোখ বড় বড় করে বলল, “কী বলছ মা, আমরা কিছু বুঝি সুঝি না!”
“ঠিক আছে। ঠিক আছে, তোরা সব কিছু বুঝিস।”
ডোরিন আর টনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাদের কাদের মামা বলল, “আপা, এদেরকে পথে ঘাটে বেশি ঘুরতে ফিরতে দিয়ো না। এদের ব্রেনের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। আমি এতো সোজা একটা প্রবলেম দিয়েছি সেটাও করতে পারে নাই।”