আমি কী আর করি, তার হাতে গাইগার কাউন্টারটা দিলাম। সে এটা হাতে নিয়ে দেখল, তার টুকরির উপর রেখে মাথা ঘুরিয়ে পরীক্ষা করল তখন হঠাৎ আমি লক্ষ করলাম গাইনার কাউন্টারটার কট কট শব্দটা একটু বেড়ে গেছে। একটু ঘন ঘন শব্দ করছে। আমি ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা লক্ষ করল না।
মানুষটা একটু পরে আমার হাতে গাইগার কাউন্টারটা ফিরিয়ে দিল এবং আমি লক্ষ করলাম তখন কট কট শব্দটা আবার কমে গেল। কী আশ্চর্য!
কিন্তু আসলেই সত্যি সত্যি হচ্ছে নাকি এটা আমার মনের ভুল কে জানে। ব্যাপারটা আমার একটু পরীক্ষা করা দরকার। তাই আমি মানুষটাকে বললাম, এই যন্ত্রটা টানতে টানতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। আপনার টুকরির উপর যন্ত্রটা একটু রাখি?”
মানুষটা বলল, “রাখ।”
আমি আবার টুকরির উপর রাখলাম এবং স্পষ্ট শুনতে পেলাম কট কট শব্দটা বেড়ে গেছে। কী রহস্যময় ব্যাপার।
আমি কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার টুকরির ভিতর কী?”
মানুষটা হাসার ভঙ্গী করল, “কিছু না। হাওড়ের পাড় গিয়েছিলাম সেইখানে একটা যষ্ঠিমধু গাছের চারা পেয়েছি। নিয়া যাচ্ছি বাড়িতে লাগব।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “যষ্ঠি মধু গাছের চারা দেখতে কেমন?”
মানুষটা তার টুকরির ঢাকনা খুলল, আমি দেখলাম ভিতরে লতানো একটা গাছের চারা। গাছের নিচে খানিকটা মাটি। মনে হয় এই মাটিটা রেডিও একটিভ। একটু পরীক্ষা করে দেখতে পারলে হতো।
আমি আমার পিছলে বুদ্ধি ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম, বললাম, “আমার গাছ খুব ভালো লাগে। এই গাছটা একটু দেখি?”
মানুষটা মনে হয় একটু অবাক হলো, কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলল, “দেখো।”
আমি এবারে হাত বাড়িয়ে তলায় লাগানো মাটিসহ গাছের চারাটাকে তুলে নিয়ে এসে চোখের সামনে ধরে দেখার ভান করলাম তারপর একেবারে গাইগার কাউন্টারের টিউবটার কাছে নিয়ে গেলাম। কটকট শব্দটা সত্যি সত্যি অনেক বেড়ে গেল। আমি আবার সরিয়ে নিলাম, শব্দটা সাথে সাথে কমে গেল। এবারে আর কোনো সন্দেহ নেই।
আমি যষ্ঠি মধু গাছটা আবার সাবধানে টুকরির মাঝে রেখে বললাম, ‘আপনি আমাকে ঠিক করে বলবেন এই চারাটা কোথায় পেয়েছেন?”
“কেন?”
“আমি যষ্ঠি মধু গাছের চারা অনেক দিন থেকে খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। ঐ জায়গায় দেখতাম আরো আছে কিনা।”
মানুষটা না সূচকভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোমারে যেতে দিবে না।”
“যেতে দিবে না?”
“না।”
“কে যেতে দিবে না।”
“কোম্পানির দারোয়ান।”
“কিসের কোম্পানি?”
‘মনে হয় সিমেন্ট কোম্পানি। কাউকে যেতে দেয় না। দারোয়ানরা বন্দুক নিয়ে পাহাড়া দেয়।”
আমি বেশ অবাক হলাম। যে সিমেন্ট কোম্পানি এখনো তৈরি হয়নি সেটা বন্দুক দিয়ে পাহাড়া দিতে হয়? তারপরও বললাম, “জায়গাটা একটু চিনিয়ে দেবেন? বলে দেখব যেতে দেয় কি না।”
মানুষটা তখন জায়গাটা চিনিয়ে দিল, আমি ঠিক চিনতে পারলাম না, মাহবুব সহজেই চিনতে পারল। জায়গাটাতে গিয়ে আমার মাটি পরীক্ষা করতে হবে। হাওড়ের কাছাকাছি এসে আমরা নৌকা থেকে নেমে গেলাম। সবাই মিলে আমরা মামার মাইক্রোবাসের দিকে হাঁটতে থাকি। মাহবুব, ডোরিন আর টনি নিজেদের ভিতরে কথা বলছে। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে থাকলাম। যষ্ঠি মধু গাছের গোড়ার মাটি থেকে গাইগার কাউন্টারে অনেক বেশি সিগন্যাল দেয়, তার মানে এই মাটিতে রেডিওএকটিভিটি আছে। কী আশ্চর্য। মামা যখন জানবে তখন কী অবাক হয়ে যাবে। আমি মাহবুব, ডোরিন আর টনিকে সত্যি কথাটা বলতে পারছি না তাই মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। সবকিছু জানলে তারা কতো উত্তেজিত হতে পারতো। মামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে এই তিনজনকে আসল কথাটা বলা যায় কি না। এরা যেহেতু কাজকর্মে সাহায্য করছে তাদের নিশ্চয়ই সত্যি কথাটা জানার অধিকার আছে!
০৮. বেশি সিগন্যাল পাওয়ার ঘটনা
০৮.
আমি মামাকে গাইগার কাউন্টারে বেশি সিগন্যাল পাওয়ার ঘটনাটা বলতেই পারলাম না। সেটা বলার জন্য মামাকে একা পাওয়া দরকার কিন্তু মামাকে একা পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার সাথে মাহবুব, ডোরিন আর টনি, তারা সব সময়েই আশে পাশে আছে।
আমাদেরকে ফিরে আসতে দেখে মামা খুশি হলো, বলল, “তোমরা ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছ। ভেরি গুড। তোমাদের দেরী দেখে একটু চিন্তা হচ্ছিল।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী চিন্তা হচ্ছিল মামা।”
“তোরা বাচ্চা মানুষ, আবার কোনো ঝামেলায় পড়িস কিনা।”
“না, মামা ঝামেলায় পড়ি নাই। আমরা চারজন একসাথে। আমাদের চারজনের বয়স যোগ করলে আমরা দুইজন বড় মানুষের সমান।”
ডোরিন বলল, “কিংবা একজন বুড়ো মানুষের সমান।”
মামা ডোরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের আব্বু কয়েকবার ফোন করেছিলেন।”
“আব্বু কী বলেছেন?”
“আমাকে বলেছেন তোমাদের সবাইকে নিয়ে মনি কাঞ্চনে যেতে। একসাথে লাঞ্চ করবেন।”
আমি আনন্দের মতো শব্দ করলাম। ডেইলি সাপ্লাই হিসেবে আমরা দুপুরে খাওয়ার জন্য যেটা এনেছি মনি কাঞ্চনের খাওয়া তার থেকে হাজার গুণ ভালো হওয়ার কথা। আমার সাথে সাথে ডোরিন অনেক জোরে এবং টনি আস্তে আস্তে হাততালি দিল। শুধু মাহবুব কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
মামা মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো, তোমার যেতে আপত্তি আছে?”
“না, ঠিক নাই, কিন্তু
“কিন্তু কী?”