ডোরিন বলল, “লাঞ্চে দরকার কোনো এক ধরনের সুপ, নুডলস এবং ভেজিটেবল। নুডলসে চিকেনের টুকরো দেওয়া যেতে পারে।”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “তোমরা বুঝতে পারছ না। বেশি ভালো খাবার দাবারের দরকার নাই, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য যেটা না হলেই না সেটা ছাড়া আর কিছু লাগবে না। যদি খুব ভালো করে বাজার করে নেই তাহলে অন্য সমস্যা হতে পারে।”
“অন্য কি সমস্যা?”
“তাহলে মামা সব সময় আমাকে পাঠাবে বাজার করতে।”
সবাই প্রথমে হাসল তারপর মাথা নাড়ল। বড়দের নিয়ে কী কী সমস্যা হতে পারে আমরা সবাই সেটা জানি। টনি চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি যদি খুব খারাপ বাজার করে নিয়ে যাও তাহলে সমস্যা হবে না?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “নাহ্! তাহলে কোনো সমস্যা নাই।”
“কেন?”
“কারণ বাজার যদি খুব খারাপ হয় আমি সব দোষ দিব তোমাদের। বলব তোমরা জোর করে আমাকে এগুলো কিনিয়েছ। আমি কিনতে চাই নাই।” বলে আমি দাঁত বের করে হাসলাম।
আমার কথা শুনে তিনজন প্রথমে চোখ পাকাল তারপর তিনজনই আমার মতো দাঁত বের করে হাসল। ডোরিন বলল, “তুমি আসলে একটা মিচকে শয়তান।”
আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করে। নিলাম, “হ্যাঁ। আমি আসলেই একটা মিচকে শয়তান।”
সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে আমাকে ডেইলি সাপ্লাই কিনে দিল। আমি সেগুলো আমার ব্যাকপেকে ভরে নিলাম। ফিরে যাবার আগে মাহবুব বলল, “চল চা খাই।”
সাথে সাথে সবাই রাজী হয়ে গেল। চায়ের দোকানটার বাইরে রাখা বেঞ্চটা একটু খালি হয়েছে আমরা সেখানে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। যে ছেলেটা চা তৈরী করছে সে প্রায় আমাদের বয়সী। অনেক যত্ন করে সে আমাদের জন্য চা তৈরি করে দিল। চায়ে চুমুক দিয়েই ডোরিন বলল, এতো মজার চা সে জীবনেও খায় নাই।
টনি যতক্ষণ মুখ ভোলা করেছিল ততক্ষণ ডোরিনের একটা কথাও সে মেনে নেয় নাই কিন্তু তার কাদের মামাকে পিছলে প্রশ্ন করে টাইট করার বুদ্ধি দেওয়ার পর থেকে সে একটু সহজ হয়েছে। এখন মাঝে মাঝেই সে আমাদের কথাবার্তায় যোগ দিচ্ছে। ডোরিনের সাথে সাথে সেও স্বীকার করে নিল যে এই চা’টা অসাধারণ। তাদের মনি কাঞ্চনের চা এর তুলনায় বাসন ধোয়া পানি ছাড়া আর কিছু না!
চা খেয়ে আমরা রওনা দিলাম। মামা আমাকে তিনটা কাজ দিয়েছিল। একটা ছিল গাইগার কাউন্টার দিয়ে এই এলাকাটা ম্যাপিং করা, একুশ দাড়ি উৎপাত করার পরও সেটা অনেকখানি করেছি। আরেকটা ছিল ডেইলি সাপ্লাই কিনে আনা সেটাও কিনে ফেলেছি। এখন বাকী আছে মাটির সেম্পল নিয়ে আসা। যেহেতু আমরা চারজন আছি তাই চার জায়গায় সেম্পল নিতে পারব। আমি মামার জিপিএসটা বের করে মামা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে সেভাবে লেটিচ্যুড লঙ্গিচ্যুড বের করে আমার নোট বইয়ে লিখে নিলাম। তারপর মাটি খুঁড়ে প্রায় দুই কেজি মাটি পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিলাম।
দুই কেজি মাটি মোটেও বেশি না কিন্তু হাঁটা শুরু করার পর মাটির ওজন আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। আমাদের কাছে শুধু মাটি না; ডেইলি সাপ্লাই আছে, গাইগার কাউন্টারটাও আছে। কাজেই সব মিলিয়ে মোটামুটি পরিশ্রম হতে লাগল এবং আমরা মাঝে মাঝেই বসে বিশ্রাম নিতে লাগলাম।
আমি বললাম, “একটা রিকশা থাকলে খারাপ হতো না।”
মাহবুব বলল, “রিকশা চালানোর জন্য রাস্তা দরকার হয়। এখানে রাস্তা নাই, রিকশা চালাবে কোথায়?”
আমরা নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটছিলাম, তখন ডোরিন বলল, “ঠিক আছে রিকশার বদলে নৌকা হলেও খারাপ হতো না।”
ঠিক তখন দেখলাম দূর থেকে একটা নৌকা আসছে। মাহবুব বলল, “দেখি এই নৌকাটাকে রাজি করাতে পারি কিনা।”
নৌকাটা কাছে আসতেই মাহবুব গলা উঁচিয়ে বলল, “মামা, যাত্রী নেবেন?”
“কই যাবা?”
“ঐ তো সামনে। হাওড়ের মুখে।”
“নাও ওঠো।”
মানুষটা নৌকাটাকে তীরের কাছে নিয়ে এলো, তখন আমরা সাবধানে উঠে গেলাম। এই নৌকাটা মাহবুবের নৌকার মতো ছোট নৌকা না তাই উঠতে কোনো ঝামেলা হলো না।
নৌকায় আরো দুইজন মানুষ বসেছিল তারা একটুখানি কৌতূহল নিয়ে আমাদের দিকে তাকালো। মাঝি জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের বাড়ি কোনখানে?”
মাহবুব আমাদের হয়ে কথা বলল, “আমার বাড়ি এইখানে কাজী বাড়ি। এরা বাইরের। দুইজন মনি কাঞ্চন থাকে। আরেকজন তার মামার সাথে গাড়িতে থাকে।”
মনি কাঞ্চন নিয়ে মাঝির খুব কৌতূহল। সে নানা ধরনের প্রশ্ন করল। অনেকগুলো প্রশ্ন বিদেশি সাহেবদের নিয়ে। এইখানে এতো বিদেশি সাহেব কেন আসে, তারা কী করে। তারা কী খায়। মদ খায় নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। ডোরিন আর টনি যেটুকু পারল সেটুকু উত্তর দিল।
নৌকায় বসে থাকা দুজন মানুষের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি গাড়িতে থাকো?”
আমি মাথা নাড়লাম।
“কেন? গাড়িতে কেন থাকো?”
আমি কিছু বলার আগে মাহবুব উত্তর দিল, “ওর মামা সায়েন্টিস্ট। গাড়িতে অনেক বড় ল্যাবরেটরি। গবেষণা করে সেইজন্য গাড়িতে থাকে।”
মানুষটা ঠিক বুঝল কি না কে জানে। আমার হাতের গাইগার কাউন্টারটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার হাতে ঐটা কী যন্ত্র?”
আমি বললাম, “এইটার নাম গাইগার কাউন্টার।”
“এইটা দিয়ে কী করে?”
আবার আমি উত্তর দেবার আগে মাহবুব উত্তর দিল। “বাতাসের দূষিত পদার্থ মাপে।”
মানুষটার যথেষ্ট কৌতূহল, সে হাত বাড়িয়ে বলল, “দেখি যন্ত্রটা।”