আমি অবাক হয়ে বললাম, “খালি প্রশ্ন করে? কী প্রশ্ন?”
টনি তার ভোতা মুখটা আরো ভোতা করে বলল, “দেখা হতেই প্রশ্ন করল একটা বিল্ডিংয়ের তিন তলায় একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে যদি মাটি থেকে তিরিশ ফুট উঁচুতে থাকে তাহলে যে সাত তলা আছে সে কত উপরে আছে।”
“তুমি কী বলেছ?”
“কী বলেছি মানে?” টনি একটু বিরক্ত হয়ে বলল “যেটা উত্তর সেটা বলেছি।”
এবারে মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “উত্তরটা কী?”
টনি বলল, “কেন? সত্ত্বর ফুট।”
আমি বললাম, “হয় নাই।”
টনি অবাক হয়ে বলল, “হয় নাই?”
“না।”
“তাহলে ঠিক উত্তর কতো?”
“জানি না।”
টনি একটু অবাক হয়ে বলল, “জান না? তাহলে বুঝলে কেমন করে যে আমার উত্তরটা হয় নাই?”
‘যদি উত্তরটা এতো সহজ হতো তাহলে তোমার মামা জিজ্ঞেস করতো না। এর মাঝে নিশ্চয়ই প্যাঁচ আছে।”
ডোরিন মাথা নাড়ল, বলল, “আছে। প্যাঁচ আছে।”
মাহবুবও মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। প্যাঁচ আছে।”
আমি বললাম, “বড় মানুষেরা সব সময় ছোটদের প্যাঁচের মাঝে রাখে।”
টনি অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু এতো সোজা একটা প্রশ্নের মাঝে প্যাঁচ থাকবে কেমন করে?”
আমি বললাম, “সোজা জিনিসের মাঝেই প্যাঁচ বেশি থাকে।”
কাজেই প্রশ্নটার মাঝে প্যাঁচটা কোনখানে সেটা চিন্তা করতে করতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। মাহবুব সবার আগে প্যাঁচটা ধরতে পারল। আনন্দে চিৎকার করে বলল, ‘নব্বই ফুট, নব্বই ফুট!”
আমরা অবাক হয়ে বললাম, “নব্বই ফুট?”
“হ্যাঁ। সাত তলায় যে আছে সে নব্বই ফুট উপরে আছে। তারপর আমাদের বুঝিয়ে দিল সেটা কেমন করে বের করেছে। আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, বুঝলাম মাহবুব সত্যিই প্যাঁচটা বুঝতে পেরেছে।
টনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মামাকে এর উত্তরটা বলে লাভ নাই। মামা তখন আরেকটা জিজ্ঞেস করবে। তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা। যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি তাহলে হতাশ ভাব দেখিয়ে মাথা নাড়ে। খুবই যন্ত্রণা।”
আমরা সবাই স্বীকার করে নিলাম, বড় মানুষদের এই রকম ব্যবহারের জন্য ছোটদের জীবনে কোনো আনন্দ নাই। আমি বললাম, তুমি একটা কাজ করো না কেন?”
“কী কাজ?”
“তোমার মামা একটা প্রশ্ন করলে তুমি আরেকটা প্রশ্ন করবে।”
“আমি আরেকটা প্রশ্ন করব?”
“হ্যাঁ। বড় মানুষদের টাইট করার মতো প্রশ্ন আছে।”
“আছে নাকি?”
“হ্যাঁ। যেমন তুমি জিজ্ঞেস করতে পার আপনি কী প্রত্যেকদিন আপনার কান ধরে টানেন?”
টনিকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখা গেল। বলল, “এটা জিজ্ঞেস করলে কী হবে?”
তোমার মামা বলবে, ‘না। তখন তুমি বলবে ও আচ্ছা, তার মানে আপনি প্রত্যেকদিন টানেন না, শুধু মাঝে মাঝে কান ধরে টানেন। তারপর জোরে জোরে হা হা করে হাসবে।”
আমার বুদ্ধি শুনে সবাই এখনই জোরে জোরে হা হা করে হাসল। আমরা তখন আরো অনেকগুলো এরকম পিছলে ধরনের প্রশ্ন টনিকে শিখিয়ে দিলাম একটা নাপিতের দাড়ি কাটা নিয়ে প্রশ্ন, একটা কেক ভাগ করা নিয়ে প্রশ্ন, একটা শেয়ালের ঘুমানো নিয়ে প্রশ্ন, একটা ভালুকের গায়ের রং নিয়ে প্রশ্ন। তখন খুব ধীরে ধীরে টনির ভোতা মুখটা একটু সহজ হলো।
কথা বলতে বলতে আর হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা বাজারে হাজির হলাম। খুবই ছোট বাজার মাত্র তিন চারটা দোকান। একটা চায়ের দোকানের সামনে দুইটা বেঞ্চ সেখানে কয়েকজন মানুষ বসে চা খাচ্ছে তারা খুবই সন্দেহের চোখে আমাদের দিকে তাকালো। এটা হচ্ছে বড় মানুষদের সমস্যা। তারা কোনো কাজকর্ম না করে দুপুর বেলা বসে বসে চা খাচ্ছে। আমরা ইচ্ছা করলেই খুবই সন্দেহের ভঙ্গীতে মানুষগুলোর দিকে তাকাতে পারতাম। আমরা তো তাকাচ্ছি না তারা কেন তাকাচ্ছে?
যাই হোক মাহবুব আমাদের একটা দোকানে নিয়ে গেল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এইখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারবে।”
ডোরিন জিজ্ঞেস করল, “কী কিনবে?”
আমি বললাম, “ডেইলি সাপ্লাই।”
“তার মাঝে কী আছে?”
“আমি কেমন করে বলব?”
ডোরিন অবাক হয়ে বলল, “তাহলে কে বলবে?”
“আমি তোমাদেরকে নিয়ে এসেছি কেন? তোমরা বল ডেইলি সাপ্লাইয়ে কী কী থাকে?”
তারা সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর ডোরিন বলল, “ডেইলি তোমরা কী কর?”
“সবাই যেটা করে আমরাও সেইটা করি।”
আবার সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। মাহবুব বলল, “বুঝেছি। টোপন কিছুই জানে না। সারাদিনে যা যা লাগে সেগুলো কিনে দেই।”
“ঠিক আছে।” ডোরিন বলল, “একেবারে সকাল থেকে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করার জন্য টুথপেস্ট, টুথব্রাশ। কুলি করার জন্য গ্লাস আর পানি। মুখ ধোওয়ার জন্য সাবান, মুখ মোছার জন্য তোয়ালে। ঘুমের কাপড় বদলে পরার জন্য শার্ট প্যান্ট জুতা মোজা। তারপর ব্রেকফাস্ট করার জন্য”
আমি হাত তুলে বললাম, “থামো থামো ঠাট্টা না করে আসলে যা যা দরকার সেগুলো কিনে দাও। খাবার দাবার হলেই হবে।”
“শুধু খাবার দাবার?”
‘হ্যাঁ।”
ডোরিন মুখ সূচালো করে বলল, “তাহলে তো সোজা। ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করি। ব্রেকফাস্ট লাগবে রুটি, মাখন, জেলি, ডিম, কলা এবং চা না হয় কফি।”
দোকানদার জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “কলা ছাড়া আর কিছু নাই।”
আমরা দোকানে ঝুলে থাকা রোগা রোগা কয়েকটা কলা দেখতে পেলাম। মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “ডিম? ডিমও নাই?”
দোকানদার মাথা চুলকালো, বলল, “ডিম কয়েকটা জোগাড় করা যেতে পারে।”