মামা যখন আমাদের বাসায় আসে তখন আমাদের আম্মু ভালো ভালো খাবার রান্না করেন। পাহাড়ে, নদীতে, জঙ্গলে মামা ঠিক করে খেতে পারে না তাই মামা খুব সখ করে কয়েকদিন খায়। রাত জেগে তার কম্পিউটারে কাজ করে তারপর হতাশার মতো করে মাথা নাড়ে। মামার ভাব-ভঙ্গী দেখে মনে হয় মামা কিছু একটা সারা দেশে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটা পাচ্ছে না! মনে হয় গুপ্তধনের মতো কিছু একটা হবে কিন্তু গুপ্তধন খোঁজার জন্য কী আর এরকম সায়েন্স ফিকশানের যন্ত্রপাতি লাগে? সিনেমায় দেখেছি গুপ্তধন খোঁজার জন্য দরকার শুধু একটা ম্যাপ আর একটা পুরানা আমলের কম্পাস!
মামা শেষবার যখন এসেছে তখন একদিন ডাইনিং টেবিলে বসে বসে আমার আম্মু আর আব্বুর সাথে কথা বলছিল। আমরা ছোট বলে বড়দের কথা বলার সময় সেখানে থাকার নিয়ম নাই তাই আমি কাছাকাছি একটা সোফায় বসে গোপনে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিলাম। আমার হাতে একটা বই, ভান করছি বই পড়ছি, আসলে পড়ছি না। বড়রা যখন কথা বলে তখন তার মাঝে অনেক ইন্টারেস্টিং কথা থাকে। অনেক সময় তারা আমাদের অন্য আত্মীয়স্বজন নিয়ে কূটনামি করে, খারাপ খারাপ কথা বলে, শুনতে বেশ মজা লাগে। (আমরা নিজেরা যদি অন্যদের নিয়ে খারাপ কথা বলি তখন কিন্তু তারা আমাদের বকাবকি করে।)
সোফায় বসে শুনলাম মামা বলছে, “বুঝলে আপা আর দুলাভাই, শেষবার যখন গিয়েছি একটা নদীর তীরে ক্যাম্প করে আছি, পূর্ণিমার রাত আকাশে একটা ইয়া বড় চাঁদ উঠেছে, জোছনায় চারিদিক থই থই করছে। একটা মানুষ নাই, শুধু দূর থেকে মাঝে মাঝে শিয়াল ডাকছে। আমি আমার কাউন্টারের পাশে বসে আছি, কুয়াশায় যেন ভিজে না যায় সেজন্য একটা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছি। হঠাৎ শুনি পায়ের শব্দ। আমি চমকে উঠলাম, ভাবলাম এতো রাতে কে যায়? তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে একা একা হেঁটে হেঁটে নদীর দিকে যাচ্ছে। নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, বাতাসে চুল উড়ছে, শাড়ীর আঁচল উড়ছে জোছনার আলোতে মনে হচ্ছে একটা অশরীরি প্রাণী! আকাশ থেকে নেমে আসা পরী!”
আম্মু বললেন, “সর্বনাশ! ভয় লাগে নাই তোর?”
মামা বলল, “ভয়? ভয় কেন লাগবে?”
“জীন ভূত কিছু যদি হয়।”
মামা হাসল, বলল, “না আপা! জীন ভূতে আমার কোনো ভয় নাই। একটা যদি পেয়ে যেতাম, ধরে বোতলে ভরে নিয়ে আসতাম এক ধাক্কায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর লাইফ সাইন্সে এক সাথে তিনটা নোবেল প্রাইজ।”
আব্বু বললেন, “তারপর কী করল সেই মেয়ে।”
“নদীর উঁচু তীর থেকে পানিতে ঝাঁপ দিল!”
আব্বু চমকে উঠলেন, “পানিতে ঝাঁপ দিল? সুইসাইড?”
মামা বলল, “প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। ছুটে দিয়ে মেয়েটাকে পানি থেকে টেনে তুলব কি না চিন্তা করছিলাম, তখন শুনলাম মেয়েটা গান। গাইছে।”
“গান গাইছে?”
“হ্যাঁ। গভীর রাতে কনকনে ঠান্ডা পানিতে একটা মেয়ে নদীতে সাঁতার কাটছে আর গান গাইছে। একেবারে অলৌকিক একটা দৃশ্য।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর কী হলো?”
“একসময় মেয়েটা পানি থেকে উঠে এলো। তারপর ভিজে শাড়িতে সপ সপ শব্দ করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। আমার কী হলো কে জানে, জোছনা রাতের মনে হয় এক ধরনের এফেক্ট আছে, আমি মেয়েটার পথ আটকে দাঁড়ালাম।”
আম্মু বললেন, “তুই মাঝ রাতে একটা মেয়ের পথ আটকে দাঁড়ালি? তোর মাথা খারাপ?”
মামা বলল, “শোন না আগে, কী হলো। মেয়েটা ভয়ে না চিৎকার করে দেয় সেই জন্য বললাম, তুমি ভয় পেয়ো না মেয়েটা কী বলল জান?”
“কী বলল?”
“বলল, ভয় পাব কেন? আপনাকে ভয় পাবার কী আছে? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে চিন? মেয়েটা বলল, চিনব না কেন? রাত বিরাতে যন্তরের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন আপনারে চিনব না! তারপর কী বলল জান?”
আম্মু বললেন, “কী বলল?”
“বলল, একটা বিয়া করেন। তাহলে রাত বিরাতে বউয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারবেন। যন্তরের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে না।”
মামার কথা শেষ হবার আগেই আব্বু আর আম্মু শব্দ করে হেসে উঠল, আমিও হাসলাম কিন্তু গোপনে।
আমি যে তাদের কথা শুনছি না আপন মনে নিজের বই পড়ছি সেটা বোঝানোর জন্য গলা উঁচিয়ে বললাম, “কী হয়েছে আম্মু? তোমরা হাসছ কেন?”
আম্মু বললেন, “কিছু না, কিছু না।”
মামা বলল, “এই, এমনিই হাসছি।”
আমি আবার সহজ সরল বোকাসোকা মানুষের ভান করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে কান খাড়া করলাম। শুনলাম, আম্মু বললেন, “মেয়েটা তো ভুল কিছু বলে নাই। ঠিকই বলেছে। তোর তো আসলেই একটা বিয়ে করা দরকার।”
মামা বলল, “আমাকে কে বিয়ে করবে?”
আব্বু বললেন, “পছন্দের কেউ থাকলে আমাদের বল আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাই।”
“ঠিক আছে দুলাভাই, যদি থাকে আপনাদের জানাব।”
আমি আবার বইয়ের আড়ালে মুখ টিপে হাসলাম। বড়রা জানে না কিন্তু আমরা ঠিকই জানি আমার পছন্দের একজন মেয়ে আছে, নাম মেহরিন, ইউনিভার্সিটির টিচার। এইখানে আমাদের একটু খানি আপত্তি আছে, টিচার মানেই রাগী রাগী চেহারার কড়া টাইপ মহিলা। মামাকে যে বিয়ে করবে তার হওয়া উচিত হাসি খুশি মজার একটি মেয়ে। টিচার মানেই বিভীষিকা।
আমি আবার কান খাড়া করলাম। শুনলাম আব্বু বলছেন, “রাত বিরেতে রোমান্টিক সেটিংয়ের একটা মেয়ে ঠিক আছে কিন্তু তুমি কেমন করে জান কোনো একদিন একটা ক্রিমিনাল এসে হাজির হবে না, কিছু একটা করে ফেলবে না।”