- বইয়ের নামঃ আমার সাইন্টিস মামা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. শব্দটা হচ্ছে সায়েন্টিস্ট
০১.
আমার মামা হচ্ছেন একজন সাইন্টিস-জানি, জানি শব্দটা সাইন্টিস না, শব্দটা হচ্ছে সায়েন্টিস্ট-বাংলায় বৈজ্ঞানিক। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বললে কেউ তার মানে বুঝতে পারে না, সায়েন্টিস্ট বললে সবাই ঘাবড়ে যায়। শর্টকাটে সাইন্টিস বললে সবাই বুঝতে পারে, মাথা নাড়ে, চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ও, আচ্ছা! তাই নাকি। ইন্টারেস্টিং।’ সেই জন্যে কারো কাছে মামার পরিচয় দিতে হলে আমি সব সময় বলি সাইন্টিস।
যাই হোক, যারা কখনো সাইন্টিস কিংবা সায়েন্টিস্ট দেখে নাই তাদের কাছে মনে হতে পারে তারা হয় বুড়ো, তাদের মাথায় থাকে বড় বড় এলোমেলো পাকা চুল এবং বড় বড় গোঁফ। তাদের নাকের উপর থাকে গোল গোল চশমা, তারা হয় খুবই ভুললামনের এবং তাদের পরনে থাকে ভুসভুসে ময়লা কাপড়। শার্টের বোতাম লাগায় উল্টাপাল্টাভাবে, জুতোর ফিতা থাকে ভোলা এবং দুই পায়ের মোজা হয় দুই রংয়ের। কিন্তু আমার মামা মোটেও সেই রকম না, আমার মামার বয়স কম, গোঁফ নাই, স্টাইলের চুল এবং সব সময় জিন্স আর টি শার্ট পরে থাকে। তার পায়ে দামি কেডস। মামা মোটেও ভুলো মনের মানুষ না, তার সবকিছু মনে থাকে-এক কথায় একেবারে টনটনে ব্রেন। মামা হাসিখুশি মানুষ, সবাইকে নিয়ে মজা করে, গল্প করে, সখ করে খায়। মামার সমস্যা একটাই সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান নিয়ে কিছু একটা প্রশ্ন করলেই মামা তখন নিজেকে সামলাতে পারে না। সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে কান ঝালাপালা করে দেয়। সেইজন্যে আমরা কখনো মামাকে বিজ্ঞান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করি না, ভুলেও জিজ্ঞেস করি না মামা কী করে। তার কথাবার্তা থেকে বোঝার চেষ্টা করি মামা কী রকম সাইন্টিস বা সায়েন্টিস্ট।
কিন্তু কিছু সায়েন্টিস্ট আছে তারা ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরের ভিতর কোনো একটা যন্ত্রের পিছনে পড়ে থাকে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত কুঁজো হয়ে তারা সেই যন্ত্র নিয়ে কাজ করে। কোনো কোনো সায়েন্টিস্ট একটা কম্পিউটারের পিছনে বসে থাকে, রাগী রাগী চেহারা নিয়ে ভুরু কুচকে কম্পিউটারের মনিটরের ছোট ছোট বিন্দি বিন্দি লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী দেখে তারাই জানে। আবার কোনো কোনো সায়েন্টিস্ট (কিংবা সাইন্টিস!) কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে বসে থাকে, কাগজে এক লাইন লিখে তারপর পেন্সিলের গোড়া চাবাতে থাকে, চাবাতে চাবাতে মাঝে মাঝে পেন্সিলের অর্ধেক খেয়েই ফেলে!
কিন্তু আমার মামা সম্পূর্ণ অন্যরকম সাইন্টিস (কিংবা সায়েন্টিস্ট!)। মামা একটা প্রজেক্ট থেকে বেশ কিছু টাকা পেয়েছে (প্রজেক্ট বিষয়টা কী, সেটা থেকে কেমন করে একজন টাকা পায় আমি সেটা জানি না। কাজকর্ম না করে সবাই প্রজেক্ট কেন করে না, টাকা কেন পায় না আমি সেটাও জানি না।) মামা কত টাকা পেয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করলে মামা বলে অনেক টাকা (অনেক টাকা মানে কতো টাকা সেটাও আমি জানি না, মামা সেটা আমাদের পরিষ্কার করে কিছু বলে না।) সেই টাকা দিয়ে প্রথমে মামা বড় একটা মাইক্রোবাস কিনেছে, এর ভিতরে পনেরোজন আরাম করে বসতে পারে। রিকন্ডিশনড না, নতুন মাইক্রোবাস। কিন্তু মামা সেই মাইক্রোবাসে পনেরোজনকে কোনোদিন বসানোর চেষ্টা না করে সামনের দুইটা সিট রেখে পিছনের সব সিট খুলে ফেলে দিয়েছে। (আসলেই ফেলে দিয়েছে, ফেলে না দিয়ে আমাদের দিয়ে দিলে আমরা সেগুলো দিয়ে খেলতে পারতাম!) তখন মাইক্রোবাসের পিছনে যে একটা ঘরের মতো খালি জায়গা হয়েছে, সেখানে একটা টেবিল আর একটা ছোট বাথরুম ফিট করেছে। দেওয়ালে একটা ফোল্ডিং বিছানা রেখেছে, টান দিলেই ঘুমানোর জায়গা হয়ে যায়। গাড়ির দেওয়ালে একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন ফিট করেছে। গাড়ির বাকি জায়গায় অনেক রকম যন্ত্রপাতি, সেগুলো কী আমি জানি না। দেখে মনে হয় একটা সাইন্স ফিকশনের সিনেমার দৃশ্য। বসার জন্য ছোট ছোট চেয়ার আছে সেই চেয়ারে বসে মামা সেই সাইন্স ফিকশনের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করতে পারে। যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য ইলেকট্রিসিটি লাগে, সেই ইলেকট্রিসিটির জন্য অনেকগুলো বড় বড় ব্যাটারি আছে, সেই ব্যাটারি চার্জ করার জন্য ছোট একটা জেনারেটর (সেই জেনারেটর যখন চালানো হয় তখন বিকট ভট ভট শব্দ হয়, এটা ছাড়া অন্য সব যন্ত্রপাতি নিঃশব্দ!) তবে মামা যখন কাজ করে তখন বড় বড় ব্যাটারির ইলেকট্রিসিটি দিয়ে কাজ করে তাই জেনারেটরের শব্দ শুনতে হয় না।
আমি জানি, যারা এইটুকু শুনেছে তারা মনে মনে ভাবছে, বাহ! কী অসাধারণ। কিন্তু আসল জিনিসটাই এখনো বলাই হয় নাই। আমার মামা সেই মাইক্রোবাসটা নিয়ে সারা দেশে ঘুরে বেড়ায়। মামার কোনো ড্রাইভার নাই, মামা নিজেই গাড়ি চালায়। মামা গাড়িতে থাকে, গাড়িতে ঘুমায়, গাড়িতে রান্না করে, গাড়িতে খায়। নির্জন কোনো নদীর তীরে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে নেমে পড়ে, সেগুলো নিয়ে নদীর তীরে বালুর মাঝে বসিয়ে কী কী জানি করে। মাঝে মাঝে নদীর তীরে গর্ত করে সেখান থেকে বালু তুলে এনে গাড়িতে বসে বসে কী যেন পরীক্ষা করে। আমরা সেটা জানি না। ভয়ে ভয়ে এক দুইবার মামাকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি মামা ঠিক করে বলে না। বিজ্ঞানের অন্য যে কোনো জিনিস জিজ্ঞেস করলে কথা বলতে বলতে মাথা খারাপ করে দেবে সেই জন্যে আমরা ভয়ের চোটে মামাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করি না! দেশের নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে মামা মাঝে মাঝে মানুষজনের মাঝে ফিরে আসে তখন মামার সাথে আমাদের দেখা হয়। তখন মামা কোথায় কোথায় গিয়েছে, কোথায় কোথায় থেকেছে সেগুলো নিয়ে গল্প করে। যন্ত্রপাতি নিয়ে কী করছে সেইটাও মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করে কিন্তু আমরা সেটা বুঝি না বলে শুনতে চাই না। অন্য কিছু নিয়ে আলাপ শুরু করে দিই!