আমার নাম সোমা!
তোমারই কী বিয়ে হচ্ছে?
হ্যাঁ।
বিয়েটা যেন কবে? আমার তারিখটা মনে নেই। কার্ড হারিয়ে ফেলেছি।
এগার তারিখ। আমি আবার আসায় তুমি কী রাগ করেছ?
রাগ করব কেন?
সোমা অপালার কাধে হাত রাখল। অপালা বলল, তুমি কী আমার বড়, না ছোট?
সোমা সে কথার জবাব দিল না। হালকা গলায় বলল, এসো, ভেতরে এসে বসো।
বাসায় কেউ নেই? কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে।
ওরা বাজারে গিয়েছে।
বিয়ের বাজার?
হ্যাঁ।
তোমার মা? উনি যাননি?
মা অসুস্থ, এখন ঘুমুচ্ছে। তুমি আমার সঙ্গে এসো।
তারা ভেতরের দিকে একটা ছোট্ট ঘরে এসে দাঁড়াল। দুদিকে দু’টি চৌকি পাতা। একটা পড়ার টেবিল। সুন্দর করে গোছানো।
এটা তোমার ঘর?
হ্যাঁ।
কে কে শোয় এখানে?
আমরা চার বোন। দু’জন দু’জন করে। তুমি বস।
অপালা বসল। বসতে বসতে বলল, শাড়িটা কী তোমার পছন্দ হয়েছে?
সোমা এবারও হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। সে বসেছে অপালার মুখোমুখি। কিন্তু এক বারও অপালার দিকে তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে।
যে ছেলেটির সঙ্গে তোমার বিয়ে হচ্ছে তাকে কী তুমি দেখেছ?
হ্যাঁ।
ছেলেটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
না।
পছন্দ হয়নি কেন?
সোমা উত্তর দিল না। তার মুখ ঈষৎ কঠিন হয়ে গেল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। সে। অপালা বলল, আচ্ছা, আমরা দু’জন কী যমজ বোন? দু’জন দেখতে অবিকল এক রকম, তাই না?
সোমা এবারও চুপ করে রইল।
আমার মনে হচ্ছে আমরা যমজ বোন। ছোটবেলায় আমাদের বোধ হয় একই রকম জামা
জুতো পরানো হত। হত না?
অপালা লক্ষ্য করল, সোমা কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। মাঝে মাঝে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। গালে সূক্ষ্ম জলের রেখা।
সোমা।
বল।
আমার কী নাম ছিল তখন? আমার কী ধারণা, জানো? আমার ধারণা, সোমার সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম ছিল রুমা।
সোমা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। সে বোধহয় চোখে কাজল দিয়েছিল, সারা মুখে কাজল লেপেট গেল।
তোমার চোখ তো এমনিতেই সুন্দর, কাজল দিতে হবে কেন? আমাদের দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর? তোমাদের ঘরে বড় আয়না আছে? এস না, দু’জন পাশাপাশি দাঁড়াই।
সোমা যেভাবে বসেছিল, সেভাবেই বসে রইল। অপালা স্পষ্ট স্বরে বলল, আমি যদি ফিরে আসি, তাহলে কার সঙ্গে ঘুমুবো? তোমার সঙ্গে?
ভেতর থেকে সোমার মা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, কে কথা বলে? কে ওখানে?
সোমা বলল, কেউ না মা, কেউ না।
আমি স্পষ্ট শুনলাম!
ভদ্রমহিলা নিজে-নিজেই বিছানা থেকে উঠলেন। পা টেনে-টেনে সোমাদের ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অপালা বলল, আপনি ভাল আছেন?
এই বলেই সে অস্পষ্টভাবে হাসল। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। টলে পড়ে যাচ্ছেন। সোমা ছুটে গিয়ে তার মাকে ধরল। একা সে সামলাতে পারছে না। সে তাকাল অপালার দিকে। অপালা নড়ল না, যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে রইল। সোমা বলল, তুমি একটু পানি এনে দেবে? মুখে পানির ছিটা দেব।
অপালা উঠে দাঁড়াল। হালকা পায়ে বারান্দায় চলে এল। ঐ তো পানির কল। মাগে করে পানি নিয়ে আসা যায়। সে পানির কলের দিকে গেল না। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে চলে এল। তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কান্না আসছে না।
ফখরুদিন সাহেব ঘণ্টাখানেক আগে এসে পৌঁছেছেন। হেলেনারও টিকিট ছিল। তিনি আসতে পারেননি। ডাক্তাররা শেষ মুহূর্তে ঠিক করেছেন হার্টে বাই পাস সার্জারির প্রয়োজন, এবং তা অল্পদিনের মধ্যেই করতে হবে। ফখরুদিন সাহেব সব ব্যবস্থা করে এসেছেন। দিন সাতেকের মধ্যে তিনি অপালাকে নিয়ে ফিরে যাবেন।
বাড়িতে পা দিয়েই তিনি মেয়ের খোঁজ করলেন। মেয়ে বাড়িতে নেই। কোথায় গিয়েছে। কেউ বলতে পারেনি। গাড়ি নিয়ে যায়নি। আজকাল প্রায়ই গাড়ি ছাড়া বের হয়। ফখরুদ্দিন সাহেব কিছুই বললেন, না। সারপ্রাইজ দেবার জন্যে খবর না দিয়ে এসেছেন। সেই সারপ্রাইজটি দেয়া গেল না।
তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সারলেন। পর পর তিন কাপ বিস্বাদ কালো কফি খেলেন। চুরুট ধরিয়ে নিচে নেমে এলেন। নিশানাথবাবুর সঙ্গে আগেই তার দেখা হয়েছে। তিনি কোনো কথা বলেননি, এখন বললেন।
কেমন আছেন?
জি স্যার, ভাল।
বসার ঘরটির এই অবস্থা করেছে?
অপালা মা খুব পছন্দ করেছে।
তার জন্যে এ রকম ঘর একটা সাজিয়ে দেয়া যাবে। আপনি এক্ষুণি আগের ডেকোরেশনে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করুন।
স্যার, করছি।
আর্টিস্ট লোকটি কী প্রায়ই এ বাড়িতে আসে?
কার কথা বলছেন স্যার?
যে এই অদ্ভুত ডেকোরেশন করেছে, তার কথাই বলছি।
জি না স্যার।
আপনি না জেনে বলছেন। দারোয়ানকে ডেকে নিয়ে আসুন।
নিশানাথবাবু ছুটে গেলেন। দারোয়ানের কাছে একটা বড় খাতা থাকার কথা। সেখানে সে
লিখে রাখবে কে আসছে কে যাচ্ছে। কখন আসছে কখন যাচ্ছে। দারোয়ান খাতা নিয়ে এল। ফখরুদিন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যাও, আমার ঘরে রেখে এস। নিশানাথবাবু।
জি স্যার।
আপনার স্ত্রী এখানে কেন?
অপালা মা একা-একা থাকে…।
সে কী বলেছিল তাঁকে আনবার কথা?
জি না স্যার।
তাহলে..?
নিশানাথবাবু ঘামতে লাগলেন। ফখরুদিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, খবরের কাগজে এত কেচ্চা-কাহিনী ছাপা হল, আপনারা ছিলেন কোথায়? পি.আর-ও সাহেবকে আসতে বলুন। যে সব পুলিশ অফিসার এই ঘটনার তদন্ত করছেন, তাদেরকে খবর দিন যে আমি এসেছি। তারা ইচ্ছা! করলে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক এক ঘণ্টার মধ্যেই চলে এলেন। পুলিশ অফিসার বলে মনে হয় না, অধ্যাপক-অধ্যাপক চেহারা। পায়জামা-পাঞ্জাবির ওপর একটা শাল চাপানো। শাল গায়ে দিয়ে কেউ অপরাধের তদন্ত করতে আসে! ফখরুদিন সাহেব বিরক্তি চেপে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললেন।