জানিব না কেন? নাও, চা খাও। তুমি কী এই কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে এসেছিল?
জি না। হঠাৎ মনে হল।
তোমার বাবা-মা ফিরবেন কবে?
টিকিট নিয়ে কী সব ঝামেলা হচ্ছে, ঝামেলা মিটলেই ফিরবেন।
খুব একা থাক আমাদের খোঁজখবর নেয়া উচিত, কিন্তু নিতে পারি না। কেন জানো?
জি না!
তোমাদের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করা মানেই আগ বাড়িয়ে গালে চড় খাওয়া। পত্রিকায় খবর দেখার পর তোমাকে টেলিফোন করেছিলাম। কী বলল, জানো?
জী বলল?
বলল, তুমি পড়াশোনা করছ, তোমাকে ডাকা যাবে না।
ওদের দোষ নেই খালা আমিই বলে দিয়েছিলাম।
ভাল, খুব ভাল।
অপালা বাসায় ফিরল
প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে অপালা বাসায় ফিরল। বাসায় অনেক মানুষ। ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলছে। কিছু লোকজন বসে আছে সেখানে। বারান্দায় চিন্তিত মুখে ম্যানেজারবাবু এবং চিটাগাং ব্রাঞ্চের জি এম. হাঁটাহাঁটি করছেন। নিশানাথবাবু ছুটে এলেন, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
অপালা তার জবাব দিল না। নিশানাথবাবু বললেন, তুমি একটু বসার ঘরে এসো। পুলিশের কয়েকজন অফিসার এসেছেন।
আমার সঙ্গে তো তাদের কোনো দরকার নেই।
আমরা বলেছি। তবু তারা কথা বলতে চান। অনেকক্ষণ বসে আছেন।
আমি তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলব না।
মা, তুমি বুঝতে পারছি না।
আমার কিছু বোঝার দরকার নেই। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আমি এখন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকব।
দু’এক মিনিটের ব্যাপার।
ম্যানেজার কাকু, আপনি আমাকে বিরক্ত করবেন না।
অপালা দোতলায় উঠে গেল। এক বারও ফিরে তাকাল না। নিশানাথবাবুর চিন্তিত মুখ আরো ঝুলে পড়ল।
নার্সদের মুখশ্ৰী ভাল থাকা উচিত।
ফিরোজের তাই ধারণা। যেন মুখের দিকে তাকিয়েই মন প্রফুল্ল হয়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মোমবাতি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন–এই দৃশ্য দেখে রুগীরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছে। কারণ ঐ মহিলা ছিলেন অসম্ভব রূপবতী। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যদি তাড়ক রাক্ষসীর মতো হতেন, তাহলে রুগীরা নিশ্চয়ই রাতের বেলা এই দৃশ্য দেখ ভিরমি খেত।
এই হাসপাতালে যে-কাটি নার্স ফিরোজ দেখেছে সবাই হয় তাড়কা রাক্ষসী, নয়ত তাড়কা রাক্ষসী হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ডাক্তার এবং নার্সদের প্ৰেম নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পউপন্যাস আছে। সে সব নিশ্চয়ই বানানো। এই ওয়ার্ডে যে গত দু’দিন ধরে আসছে তার চেহারা মন্দ নয়, তবে কথাবার্তা অসহ্য।
ধমক না দিয়ে কোনো কথা বলে না। আজ সকালেই ফিরোজের সঙ্গে বড় রকমের কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। মেয়েটি ওয়ার্ডে ঢুকেই কড়া গলায় বলল, এই যে লোক, বসে আছেন কেন?
এই যে লোক বলে কেউ সম্বোধন করতে পারে, এটাই ফিরোজের ধারণা ছিল না। সে বহু কষ্টে রাগ সামলে বলল, বসে থাকা নিষেধ আছে নাকি?
হ্যাঁ, আছে। শুয়ে-শুয়ে রেস্ট নিন। ডন-বৈঠকের জন্যে হাসপাতাল না।
ফিরোজ শুয়ে পড়ল। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। রাত-দুপুরে আজেবাজে কোনো ওষুধ খাইয়ে দিতে পারে। একটা থ্রিলারে এ রকম একটা ঘটনা ছিল। নার্স রাত-দুপুরে ঘুমের ওষুধ বলে আফিমের ঢেলা গিলিয়ে দিত। অবশ্যি সেই নার্স ছিল রূপবতী এবং সে বেছে বেছে এই কাণ্ডগুলো করত। রূপবান তরুণ রুগীদের সঙ্গে।
ফিরোজ গলা পর্যন্ত চাদর টেনে কৌতূহলী চোখে নার্সটাকে দেখছে। এই মহিলা এক-একটা বেডের কাছে যাচ্ছে এবং বিনা কারণে রুগীদের ধমকাচ্ছে। গরিব রুগীদের তুমি-তুমি করে বলছে। সে খুরে-ঘুরে আবার ফিরোজের কাছে ফিরে এল।
আপনার জ্বর রেমিশন হয়েছে।
ফিরোজ জবাব দিল না। নার্স তার এ্যাপ্রনের পকেটে হাত দিয়ে বলল, আপনার একটা চিঠি এসেছে। গতকাল দিতে ভুলে গেছি। এই নিন।
ফিরোজ থমথমে গলায় বলল, আপনি চিঠি পড়েছেন কেন? খামের মুখ খোলা।
আপনার চিঠি পড়ার আমার দরকারটা কী? মুখখোলা অবস্থাতেই এসেছে। চিঠি পড়ুন, বালিশের নিচে রেখে দিচ্ছেন কেন?
আপনি এখান থেকে যান, তারপর পড়ব।
নার্স চলে যাবার পরও সে চিঠি পড়ল না। হাসপাতালে বসে চিঠি পাওয়ার বিস্ময়টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যাক। নার্স যে চিঠিটা পড়েছে, তাতে তাকে ঠিক দোষ দেয়া যায় না। হাসপাতালের রুগীদের কেউ চিঠি লেখে না, দেখতে আসে। গত দশ বছরে এটাই হয়ত প্রথম চিঠি এবং ফিরোজের ধারণা, হাসপাতালের জমাদারনী, মালী, ওয়ার্ডবয়… সবাই এই চিঠি পড়েছে।
কে লিখতে পারে এই চিঠি? তাজিন? হতে পারে। পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র সে-ই তাকে দেখতে আসেনি। দুলাভাই বলেছেন–রাগ করে আসেনি। ফিরোজ অবাক হয়ে বলেছে, রাগ কী জন্যে?
নিজের দিকে তুমি তাকাবে না। অসুখ-বিসুখ বঁধিয়ে খবর পাঠাবে, সে রাগ করবে না? শোন ফিরোজ, তুমি কথা দাও, রিলিজ হলে আমার বাসায় গিয়ে উঠবে।
কথা দিলাম।
আমরা যে-মেয়ে ঠিক করব, চোখ বন্ধ করে তাকে বিয়ে করবে।
কথা দিলাম!
তোমাকে কেবিনে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করছি। সব ধরাধরির ব্যাপার। একজন মেজর জেনারেলকে আজ ধরব। আমার ভাবির ফুপাত ভাই।
কাউকে ধরতে হবে না দুলাভাই। ওয়ার্ডে আমি ভালই আছি। আশপাশের রুগীদের সঙ্গে খাতির হয়েছে। গল্পগুজব করে সময় কেটে যাচ্ছে।
কার সঙ্গে খাতির হল?
বাঁ পাশের বেডের রুগীর সঙ্গে। খাতিরটা আরো জমত, বেচারা হঠাৎ মরে যাওয়ায় খাতিরটা জমতে পারল না।
সব সময় এমন ঠাট্টা-তামাশা করো না। মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করবে না।
আর করব না। আপনি দুলাভাই, বড় আপনাকে পাঠিয়ে দেবেন। আপাকে দেখতে ইচ্ছা! করছে।