অপালা বলল, এই মেয়েটির সঙ্গেই কী ফিরোজ সাহেবের বিয়ের কথা হচ্ছে?
হাজি সাহেব এবং তাঁর মেয়ে দু’জনই চমকে উঠল। মেয়েটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাজি সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার হাতে একটা নোটবই। নোটবইটা হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। তিনি অত্যন্ত গভীর গলায় বললেন, বিয়ের কথা তুমি কী বললে?
আমি বোধহয় কোনো ভুল করেছি। কিছু মনে করবেন না।
ভুল না, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি গোড়া থেকে সে রকমই সন্দেহ করছিলাম। ওর মাকে বলেছিও কয়েক বার।
দরজা ধরে দাঁড়ানো মেয়েটি চট করে সরে গেল। হাজি সাহেব বললেন, মুখ ফুটে নিজের কথা বললেই হয়, কিংবা আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে বলতে পারে, তা না!
বিস্মিত অপালা বলল, বিয়ের ব্যাপারে তাহলে উনি আপনাদের কিছু বলেননি?
আরে না! একেক সময় একেক কথা বলে। এক বার বলল, বিয়ের সব দায়িত্ব আমার। তখনই সন্দেহ হল। চালাক ছেলে। তুমি বস, দাঁড়িয়ে আছ কেন? দাঁড়াও, চায়ের কথা বলে আসি। আর এই হল ঠিকানা, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ওয়ার্ড নাম্বার পাঁচ। বেড নাম্বার তেতাল্লিশ। ওয়ার্ডে ঢুকেই প্রথম বিছানাটা।
অপালাকে ঘণ্টাখানেক বসতে হল। হাজি সাহেবের স্ত্রী এই এক ঘণ্টা ক্রমাগত কথা বললেন। মোটাসোটা ধরনের মহিলা, কথা বলার সময় খুব হাত নাড়ান। শুরুই করলেন মা ডাক দিয়ে।
মা, তোমার নাম কী?
অপালা।
ও-মা, কী অদ্ভুত নাম! তুমি আমার কথায় কিছু মনে করলে না তো?
জি না।
তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি। একটা ঝামেলা মিটে গেল। ছেলের মনে কী ছিল তা তো আর আমরা জানি না। জানলে এত দিনে শুভ কাজ সমাধা হয়ে যেত ইনশাআল্লাহ।
হাজি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, এসেই কী বকবক শুরু করলে? চুপ কর তো। চুপ করব কেন? আমরা মেয়েতো-মেয়েতে কথা বলছি, তুমি এর মধ্যে থাকবে না। বারান্দায় গিয়ে বস।
মেয়েটি চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকেছে। একটা প্লেটে পাপর ভাজা, অন্য একটা প্লেটে সুজির হালুয়া। সে খুব সাবধানে ট্রে নামিয়ে রাখল। এক বারও চোখ তুলে তাকাল না। ভয়ে-সঙ্কোচে সে এতটুকু হয়ে গেছে। এখন ভাল লাগছে মেয়েটিকে দেখতে।
হাজি সাহেবের বাড়ি থেকে বেরুতে-বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা কারো বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। সন্ধ্যাবেলা শুধু পশু এবং পাখিরাই ঘরে ফিরবার জন্যে ব্যাকুল হয়। মানুষ হয় না। উষা এবং গোধূলি হচ্ছে গৃহত্যাগের লগ্ন।
ড্রাইভার বলল, বাসায় যাব। আপা?
না, এমনি একটু রাস্তায় চালান।
মীরপুর রোড ধরে যাব?
যান।
শ্যামলীতে বড় খালার বাড়ি। তার সঙ্গে এক বার দেখা করে এলে কেমন হয়? কত দিন ওবাড়িতে যাওয়া হয় না। খালাও আসেন না। মা মাঝে মাঝে এ-বাড়িতে আসেন, কিন্তু অপালাকে সঙ্গে আনেন না। কেন আনেন না। এ নিয়ে সে কখনো মাথা ঘামায়নি। আজ তার মাথায় কাম-কাম করে বাজতে লাগল–মা আমাকে এ বাড়িতে আনেন না, মা আমাকে এ বাড়িতে আনেন না। যেন রেকর্ডে পিন আটকে গেছে, তুলে না দেয়া পর্যন্ত বাজতেই থাকবে।
ড্রাইভার সাহেব।
জি আপা।
শ্যামলী চলুন। বড় খালার বাসায়। বড় খালার বাসা চেনেন না?
জি, চিনি। চিনিব না কেন?
বড় খালা অপ্রসন্ন মুখে বললেন, তারপর রাজকন্যা, কেমন আছ?
অপালা হেসে ফেলল। আমি ভাল আছি বড় খালা।
সন্ধ্যাবেলা কী মনে করে? আমাদের বাড়িঘর তো তোমার জন্যে নিষিদ্ধ এলাকা। ফরবিডেন জোন।
ফরবিডেন জোন হবে কেন?
আমি তো জানি না, আছে নিশ্চয়ই কোনো কারণ। রাজকন্যার কী সব জায়গায় যেতে পারে, না যেতে পারা উচিত? বাস, দাঁড়িয়ে আছ কেন?
বসব না খালা। আমি এখন যাব।
এখন যাবে মানে! তাহলে এসেছে কেন?
অপালা বসল। বড় খালা গম্ভীর মুখে বললেন, এমনিতে তো তোমাদের খবর পাওয়ার উপায় নেই। পত্রিকায় অবশ্যি ইদানীং পাচ্ছি।
অপালা বিস্মিত হয়ে বলল, পত্রিকায় খবর মানে! পত্রিকায় আবার কী খবর?
সে কী! তুমি পত্রিকা পড় না?
জি না।
দেশী পত্রিকা তোমার বাবা পড়তে দেন না বোধহয়।
তা নয়। খালা, ইচ্ছা করে না। কী খবর বেরিয়েছে?
দু’টা খুন হয়েছে তোমাদের টঙ্গির কারখানায়। খুনি ধরা পড়েছে। তার ছবিটবি দিয়ে নিউজ হয়েছে। সে বলছে, তোমার বাবার নির্দেশেই এই কাণ্ড সে করেছে। সব পত্রিকাতেই তো আছে, তুমি কিছুই জানো না?
জি না।
না জানাই ভাল।
খুব চিন্তা লাগছে খালা।
চিন্তা লাগার কী আছে? টাকাওয়ালা মানুষদের এইসব সামান্য জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তোমার বাবা আসুক। দেখবে, সব ঠিক হয়ে গেছে। ঐ খুনিই তখন উল্টো কথা বলবে। বস তুমি, আমি দেখি, চা-টার ব্যবস্থা করি। তোমার ঠিকমত যত্ন হয়নি এই খবর তোমার বাবার কানে উঠলে উনি রেগে যাবেন। জগৎ শেঠদের রাগাতে নেই।
অপালা একা একা বসে রইল। এক বার বড় খালার মেয়ে বিনু এসে বলল, ছবি দেখবে আপা? বালিকা বধু আছে। খুব ভাল প্রিন্ট।
তুমি দেখ। আমার ইচ্ছা করছে না।
আমি চার বার দেখেছি আপা। তুমি দেখলে তোমার সঙ্গে আবার দেখব।
আমার আজ একটুও ইচ্ছা করছে না। ভীষণ মাথা ধরছে।
মাথা ধরার ব্যাপারটা মিথ্যা নয়। আসলেই প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। ইচ্ছে করছে ছুটে বেরিয়ে যেতে। তা সম্ভব নয়। বড় খালা তার সামনে প্রচুর খাবারদাবার সাজিয়ে রাখছেন। তার মুখে কী অদ্ভুত এক ধরনের কাঠিন্য!
বড় খালা।
বল।
আমার জন্ম কী হাসপাতালে হয়েছিল?
তা দিয়ে তোমার কী দরকার?
এমনি জিজ্ঞেস করছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, জানেন না?