ফখরুদিন সাহেব গভীর রাতে টেলিফোন করলেন। গভীর রাতের টেলিফোন গলা অন্যরকম শোনা যায়। চেনা মানুষকেও অচেনা মনে হয়। অপালা বলল, আপনি কে?
ফখরুদিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কী আমাকে চিনতে পারছি না, মা?
ও, বাবা তুমি?
হ্যাঁ, আমি! তোমার কী হয়েছে?
কই, কিছু হয়নি তো!
মা, সত্যি করে বল তো।
সত্যি বলছি, আমার কিছু হয়নি, শুধু…
শুধু কী?
আমার খুব একা-এক লাগছে বাবা।
ফখরুদিন সাহেব টেলিফোনেই কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। তাঁর অসম্ভব মন খারাপ হয়ে গেল।
মা, তুমি কী কাঁদছ?
হ্যাঁ, কাঁদছি। আর কোদব না।
কিছু একটা তোমার হয়েছে। সেটা কী?
অপালা চুপ করে রইল। ফখরুদিন সাহেব বললেন, আমাকে বলতে কী তোমার কোনো বাধা আছে?
বলার মত কিছু হয়নি বাবা।
কোনো ছেলের সঙ্গে কী তোমার ভাব হয়েছে? নিশানাথ বলছিল আর্টিস্ট একটা ছেলে নাকি আসে প্রাযই। তুমি কী আজ তার কাছে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, গিযেছিলাম।
সে কী এমন কিছু বলেছে, যাতে তোমার মন খারাপ হয়েছে?
না।
এই ছেলেটিকে তোমার কী পছন্দ হয়? যদি হয় আমাকে বল। তুমি যা চাইবে তাই হবে। যা হওয়ার নয়, তাও আমি হওয়াব। আমার প্রচুর ক্ষমতা।
ফখরুদিন সাহেবের মনে হল, অপালা আবার কাঁদতে শুরু করেছে। তিনি বললেন, ঐ ছেলে যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকে, আমি টেনে তার জিভ ছিঁড়ে ফেলব।
ঐ সব কিছু না বাবা, এমনিতেই আমার মন খারাপ। তুমি তো জান, মাঝে মাঝে আমার মনখারাপ হয়।
এটা তো ভাল কথা না। এটা একটা অসুখ, এর নাম মেলাংকলি। আমি ঢাকায় এসেই বড় বড় ডাক্তার দেখাব।
কবে আসবে ঢাকায়?
তোমার সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেই আমি ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করব। এখানে আমার অনেক ঝামেলা, তবুও আমি ফাস্ট এ্যাভেইলেবল ফ্লাইটে চলে আসব। তোমার মাকেও নিয়ে আসব।
আচ্ছা।
তুমি কী আর কিছু বলবে?
না।
তুমি কী জেগে ছিলে নাকি মা?
না।
এত রাত পর্যন্ত জেগে জেগে কী করছিলে?
ছবি দেখছিলাম।
কী ছবি দেখছিলে?
আমার ছবি। কত ছবি যে তোমরা আমার তুলেছ!
দ্যাটস রাইট। ফটোগ্রাফির হবিটা একসময় বেশ জোরােলই ছিল। এখন নেই। ভাবছি, আবার শুরু করব। একটা ডার্ক রুম বানিয়ে নিজেই ছবি ডেভেলপ করব। কেমন হবে?
ভালই হবে। বাবা।
বল মা।
আমার এত ছবি, কিন্তু খুব ছোটবেলার ছবি নেই কেন?
তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
জন্মের পর পর তোলা ছবি। এক বছর-দুবছর বয়সের ছবি।
ফখরুদ্দিন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। অপালা যখন দ্বিতীয় বার প্রশ্নটি করতে যাবে তখন তিনি বললেন, তোমার ছোটবেলার ছবিও আছে। না-থাকার তো কোনো কাবণ নেই। আমি এসে তোমাকে খুঁজে দেব।
আচ্ছা।
তোমার ছোটবেলায় আমি একটা ঝামেলায় পড়েছিলাম। ব্যবসা-সংক্রান্ত ঝামেলা। মনমেজাজ ভাল ছিল না। প্রচুর ছোটাছুটি করতে হত, ছবি তোলার তেমন মুড় ছিল না। ছবি তোলা, কবিতা এবং গল্প লেখার মতই একটা মুডের ব্যাপার।
তা ঠিক।
একেবারেই যে তুলিনি তা নয়। কিছু কিছু নিশ্চয়ই তোলা হয়েছে। তবে আরো বেশি তোলাব প্রয়োজন ছিল। আমি ফিরে আসি, তারপর দেখবে প্রতিদিন এক রোল করে স্ন্যাপ নেব।
বাবা।
বল মা।
আগামীকাল আমার একটা পরীক্ষা আছে।
ও, আই অ্যাম সরি। এতক্ষণ তোমাকে ডিস্টার্ব করা খুবই অনুচিত হয়েছে।
অপালা ক্ষীণ স্বরে বলল, কাল যদি পরীক্ষাটা না দিই, তাহলে কী তুমি বাগ করবে?
মা, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
কাল আমার পরীক্ষা দিতে ইচ্ছা করছে না। যদি পরীক্ষার হলে যাই, তাতেও লাভ হবে না। একটা লাইনও লিখতে পারব না।
কেন?
আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।
শরীর খারাপ লাগলে তো পরীক্ষা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মা, তুমি শুয়ে থাক। আমি আসছি, এসেই সব ঠিক করে দেব।
অপালা টেলিফোন রেখে খাবার ঘরে গেল। এত রাত হয়েছে, তবু কেউ ঘুমাযনি। সবাই জেগে আছে। সে আজ সারা দিন কিছু খায়নি, রাতেও খায়নি এই জন্যেই জেগে আছে হয়ত।
রমিলা।
জি আফা।।
আমি এক কাপ কফি খাব। খুব কড়া করে এক কাপ কফি দাও।
সাথে আর কিছু দিব আফা?
এক টুকরো পনির কেটে দিও। আমার ঘরে নিয়ে এসো। আর শোন, তোমরা সবাই জেগে আছ কেন? শুয়ে পড়া।
অনেক দিন পর অপালা তার খাতা নিয়ে বসেছে। ঘুম ঘুম একটা ভাব ছিল, কফি খাওয়ায় সেই ভাব কেটে গেছে। খুব ক্লান্তি লাগছে, আবার ইচ্ছেও করছে কিছু একটা লিখতে। অপালা লিখতে শুরু করল।
আমার বাবা
যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন বাংলার স্যার একটা রচনা লিখতে দিলেন তোমার প্রিয় মানুষ। কেউ লিখল রবীন্দ্রনাথ, কেউ শরৎচন্দ্র। কিছু-কিছু স্মার্ট মেয়েরা বিদেশের নামকরা লোকদের প্রিয় মানুষ বানিয়ে রচনা লিখল, লেনিন, আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা। আমি লিখলাম, আমার প্রিয় মানুষ আমার বাবা। কেন তিনি আমার প্ৰিয় মানুষ তাও লিখলাম। ছোট ছোট কিছু ঘটনার কথা লিখলাম।–যেমন, আমার এক বার টনসিল অপারেশন হল। সলিড কিছু খেতে পারি না। বাবার তা দেখে খুব কষ্ট হল। তিনি বললেন, আমার মা যত দিন সুস্থ না হয়েছে, তত দিন আমিও সলিড কিছু খাব না। সত্যি সত্যি তিন দিন তাই করলেন। দুধ, মুরগির সুপ। এইসব খেয়ে কাটালেন। আরেক বার আমার প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা। মাটীর হাড়ে কী যেন হয়েছে। কত ওষুধ কত ডাক্তার, ব্যথা কমে না। আমার কষ্ট দেখে বাবা যেন কী-রকম হয়ে গেলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট বাচ্চাদের মত শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার! বাবার কান্না শুনে আমার ব্যথা কমে গেল। আমি বললাম, বাবা তুমি কাঁদবে না, আমার ব্যথা কমে গেছে। বাবা মনে করলেন আমি তাকে সান্তুনা দেবার জন্যে বলছি। তিনি আরো শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। এই মানুষটি যদি আমার প্রিয় না হয়, তাহলে কে হবে? রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, মাদার তেরেসা–এঁরা মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ, পৃথিবীর সবার প্রিয়। কিন্তু আমি সামান্য মানুষ, আমার প্রিয় মানুষটিও সামান্য।