লা বেলে পত্রিকায় আরেকটি মজার খবর ছাপা হল। দুটি নাগরিক কমিটি বৈঠকে বসে ঠিক করেছে জামশেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা সবরকম সাহায্য দেবে। বৈঠকের শেষে তার জামশেদের জন্যে বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করেছে।
শহরে এখন অনেক গাড়ি দেখা যেতে লাগল যেগুলোর গায়ে নতুন ধরনের সব স্টিকার, জামশেদ, আমরা আছি তোমার সাথে। তুমি চালিয়ে যাও, জামশেদ। এই গাড়িটিতে জামশেদের জন্যে একটি আসন আছে।
.
সকাল থেকেই মেঘ করেছিল।
দুপুরের দিকে ঝুপঝপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। এতরা একবার ভাবল আজ আর মা’র কাছে যাবে না। টেলিফোনে খোঁজ নেবে। এই ভাবনা অবিশ্যি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আজ মঙ্গলবার মা’র কাছে না গেলেই নয়। এতরা বিরক্তমুখে গাড়ি বের করতে বলল। দিনকাল এমন হয়েছে হুটহাট করে কোথাও যাওয়া যায় না। তিন চারজন দেহরক্ষী সঙ্গে রাখতে হয়। গাড়িতে বসতে হয় মাথা নিচু করে। সবসময় একটা আতঙ্ক। এরকম অবস্থায় মানুষ থাকতে পারে? সবচেয়ে ভালো হয় মাসখানেকের জন্যে অন্য কোথাও চলে গেলে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই সব ঝামেলা মিটে যাবে। একটিমাত্র মানুষ কী করে একরম একটা ঝামেলা সৃষ্টি করে কে জানে! খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। অবিশ্যি ক্যানটারেলা বলেছে তিন দিনের মাথায় লোকটিকে খুঁজে বের করা হবে। এবং জীবিত অবস্থায় চামড়া তুলে নিয়ে সমুদ্রের নোনা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখা হবে। ক্যানারের কথায় বিশ্বাস করা যায়, এতরা ফালতু কথা কম বলে
এতরা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই নিচে থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, স্যার, আমরা তিনজনই কি সঙ্গে যাব?
হ্যাঁ
তা হলে কুকুর সামলাবার জন্যে কেউ থাকবে না। কুকুর দুটো কি চেইন দিয়ে আটকে রাখব।
রাখো। সবকিছুই আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজ করবে।
এতরা ভ্রূ কুঞ্চিত করল। যে-তিনজন দেহরক্ষী রাখা হয়েছে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নস্তরের বলেই এতরার ধারণা। সারাক্ষণ কথাবার্তা বলছে। ফুর্তিবাজের ভঙ্গি। কোথায়ও যখন বের হয় এমন ভাব করে যেন পিকনিকে যাচ্ছে। ইডিয়েটস। এতরা ভারী গলায় বলল, কুকুর বাধা হয়েছে?
জি স্যার।
ভালো করে বাঁধ। আর শোনো, দিনের বেলা এ যেন বাঁধা থাকে। এদের ছাড়বে সন্ধ্যা সাতটার পর। বুঝতে পারছ?
খুব পারছি, স্যার।
এতরা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে নিচে নেমে এল। কুকুর দুটো তাকে দেখামাত্র গোঁগোঁ শব্দে একটা রাগী আওয়াজ করল। এতরার ভ্রূ দ্বিতীয়বার কুঞ্চিত হল। এই কুকুর দুটোকে সে পছন্দ করে না। এদের শীতল চোখের দিকে তাকালেই এতরার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। এরকম একটা ভয়াবহ জীবকে মানুষের বন্ধু নাম দেয়ার কী মানে? এতরা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। সময়টা তার খারাপ যাচ্ছে। যেসব জিনিস সে পছন্দ করে না তার চারপাশেই এখন সেসব জিনিস। অটোম্যাটিক অস্ত্র হাতে কয়েকন নির্বোধ অথচ ভয়াবহ মানুষ। দুটো হিংস্র কুকুর যারা মনিবকে দেখে গোঁগোঁ শব্দে গর্জন করে। কোনো মানে হয়?
এতরার মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখ হাসিহাসি, এর মানে ঘরে কেউ লুকিয়ে নেই। তবু একটা ক্ষীণ সন্দেহ থেকে যায়। হয়তো সাবমেশিনগান হাতে জামশেদ নামের কুকুরটা ঘাপটি মেরে বসে আছে রান্নাঘরে। বিচিত্র কিছুই নয়। ওই কুকুরটার পক্ষে সবই সম্ভব। এতরা ক্ষীণস্বরে বলল, তোমরা দুজন গিয়ে ভালো করে খুঁজে দেখবে, কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কি না। তারপর গাড়িতে বসে না থেকে বাড়ির চারপাশে ঘুরবে। চোখকান খোলা রাখবে।
বৃষ্টি পড়ছে সিনোর।
পড়ুক।
দুজন গম্ভীরমুখে নেমে গেল। কী বিরক্তিকর অবস্থা! স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় না। সারাক্ষণ একটা দম-বন্ধ-করা আতঙ্ক। এরকম কিছুদিন চললে পাগল হয়ে যেতে হবে।
এতরার মা ব্যাপারস্যাপার দেখে খুবই অবাক। হচ্ছে কী এসব?
কিছুই হয়নি। একটু সাবধানে চলাফেরা করছি। এতে অবাক হবার কী আছে?
হঠাৎ করে এত সাবধানতারই-বা কী আছে?
এতরা জবাব দিল না। মুখ কালো করে বসে রইল।
আমার মনে হয় তোমার ওজনও কমেছে। দশ পাউন্ড ওজন কমেছে।
ওজন ঠিকই আছে।
মোটেই ঠিক নেই। আমি ওজনের যন্ত্র আনছি, মেপে দ্যাখো।
থাক, মাপতে হবে না।
অবশ্যই হবে। কথার ওপর কথা বলবে না। যা বলছি করো।
বুড়ি ওজনের যন্ত্র নিয়ে এল। দেখা গেল সত্যি আট পাউন্ড ওজন কম।
সাত দিনে আট পাউন্ড ওজন কমেছে, এর মানে কী?
কমেছে, আবার বাড়বে। এই নিয়ে এত হৈচৈ কেন?
ইদানীং তোমার কোনো শত্রু তৈরি হয়েছে কি?
নাহ্।
ঠিক করে বল।
দুএকজন হয়তো আছে, সে তো সবারই খাকে। দুষ্ট লোকের অভাব আছে নাকি পৃথিবীতে!
তা ঠিক।
বুড়ি কফি তৈরি করতে লাগল। ক্রিম মেশাতে মেশাতে আড়চোখে দুএকবার তাকাল ছেলের দিকে। এতরার চোখে কেমন যেন দিশাহারা ভাব। বুড়ি কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল, পৃথিবীতে ভালো লোকও আছে।
আছে নাকি?
হ্যাঁ। ঐ বিদেশী লোকটার কথাই ধরো।
কার কথা বলছ!
ঐ যে জামশেদ না কী যেন নাম।
এতরা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, ও ভালো লোক সে-ধারণা তোমার হল কোত্থেকে
সবাই তো বলছে।
সবাই মানে পত্রিকাওয়ালার বলছে। ওরা দিনকে রাত করতে পারে। একটা খুনি বদমাশকে স্বর্গীয় দূত বানিয়ে দেয়।
একটা বিদেশী লোক একা একা যুদ্ধ করছে এটা তোমার চোখে পড়ে না!
এতরা কফির কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল।