এইজাতীয় হত্যাকাণ্ড সে আরো করবে কি না তা বলেছে?
আমার মনে পড়ছে না।
কফি খাও। কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
নিমো কফিতে চুমুক না দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছল।
ভিকি খবরের কাগজের প্রথম পাতায়
১৬.
ভিকি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা খবরটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারল না। তাকে দ্বিতীয়বার খরবটি পড়তে হল। শিরোনাম হচ্ছে একক যুদ্ধ। অসীম সাহসী একজন প্রৌঢ়, যার নাম জামশেদ, সে একাকী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এমন সব অপরাধীর বিরুদ্ধে, যাদেরকে পুলিশ কিছুই বলে না বা বলবার ক্ষমতা রাখে না। বেশ বড় খবর। সেখানে অ্যানির মৃত্যু-প্রসঙ্গ আছে। এবং ভয়ংকর দুজন অপরাধী যারা অল্প কিছুদিনের ভেতর মারা গেল তাদের কথাও আছে। নিমো নামের মেয়েটার ক্ষুদ্র একটি সাক্ষাৎকারও আছে।
ভিকি দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইল চেয়ারে। আজ ছুটির দিন, রুনকে নিয়ে তার বে ল্যান্ডে যাবার কথা। সেখানে একটি ছোট্ট কটেজ ভাড়া নেয়া হয়েছে। কিন্তু ভিকির আর যেতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে করছিল, রুনকে পাশে বসিয়ে অ্যানির পুরানো দিনের ছবিগুলি দেখে। কিংবা কবরখানায় গিয়ে অ্যানির ছোট্ট কবরটিতে কিছু ফুল দিয়ে আসে। ফুলের সঙ্গে থাকবে এই খবরের কাগজটি যেখানে অনাত্মীয় একটা বিদেশীর কথা আছে। যে ছোট্ট অ্যানির ভালোবাসার উত্তর দিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ভিকির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। রুন ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
এই খবরটা পড়ো।
রুন নিঃশব্দে পড়ল। তার চেহারা দেখে মনে হল না তার কোনো ভাবান্তর হয়েছে। ভিকি মৃদুকণ্ঠে বলল, বে লান্ডে যাবে আজ?
নাহ।
কী করবে? সিমেট্রিতে যাবে?
নাহ। বলেই অনেক দিন পর গভীর ভালোবাসায় রুন তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার মেয়ে আর অন্ধকার কফিনে শুয়ে শুয়ে কাঁদবে না। অন্তত একজন তার ভালোবাসার সম্মান রেখেছে। আমার মামণির আজ খুব আনন্দের দিন।
.
রিনালো অফিসে এসেই শুনল তাকে কবার টেলিফোনে খোঁজ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে অফিসে পৌঁছামাত্রই যেন সে এই নাম্বারে যোগাযোগ করে। বিশেষ প্রয়োজন।
রিনালো দেখল নাম্বারটা অপরিচিত। কে হতে পারে? ডায়াল ঘোরানো মাত্রই মৃদু স্বর শোনা গেল, ভিকামডিয়া বলছি।
আমি রিনালো, কী ব্যাপার?
আজকের খবরের কাগজ দেখেছেন, মিঃ রিনালো?
হ্যাঁ।
বিশেষ কোনো খবর আপনার চোখে পড়েছে কি?
কোনটির কথা বলছেন? লাওসের হাঙ্গামা?
না। লাওস নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপনি কি দেখেননি খবরের কাগজের লোকরা কীভাবে একজনকে হিরো বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে?
জামশেদের কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
দেখেছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাকে টেলিফোন করবার কারণটা ঠিক ধরতে পারছি না।
আপনার কি মনে হয় না ব্যাপারটা নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে?
আপনি ভুল জায়গায় টেলিফোন করছেন। আমি খবরের কাগজের লোক নই।
মিঃ রিনালো, আমি ঠিক জায়গাতেই টেলিফোন করেছি।
তার মানে?
আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন কোনো কাগজেই এত বড় একটা হিরোর কোনো ছবি ছাপা হয়নি। এবং আমি যতদূর জানি পুলিশ বিভাগ ছবি ছাপাতে নিষেধ করেছে।
পুলিশ বিভাগের স্বার্থ?
লোকটা বিদেশী। ছবি ছাপা হলেই সে পরিচিত হয়ে পড়বে। দ্রুত ধরা পড়বে। আপনারা চান না সে ধরা পড়ুক।
আপনার এরকম অনুমানের কোনো ভিত্তি আছে কি?
কিছুটা আছে। আমরা ওর ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে চেয়েছিলাম। পত্রিকাওয়ালারা সেটা ছাপতে রাজি নয়। অপরাধীকে ধরিয়ে দিন এই শিরোনামে বিজ্ঞাপন।
আপনারা এইজাতীয় বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছেন?
বিজ্ঞাপনটা দেয়া হয়েছিল উদ্বিগ্ন জনসাধারণের নামে।
ও, তা-ই বুঝি।
হ্যাঁ, মিঃ রিনালো। আমরাও জনগণ। ট্যাক্স দিয়ে বাস করছি।
মিঃ ভিকানডিয়া।
বলুন।
আমার কেন জানি ধারণা হচ্ছে, এই একটা লোকের জন্যে আপনারা কিছুটা বিচলিত হয়েছেন।
মোটেই না। পত্রিকাওয়ালারা জিনিসটাকে একটা সেন্টিমেন্টালে রূপ দিতে চাচ্ছে, সেখানেই আমার আপত্তি।
লোকটা কিন্তু সহজ পাত্রও নয়, মিঃ ভিকানডিয়া।
আড়াল থেকে গুলি করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি দেখি না।
বাহাদুরি দেখানোর তার কোনো ইচ্ছাও বোধহয় নেই। ভালো কথা, আপনি এখনও হয়তো খবর পাননি, নিওরোর মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
কী বলছেন?
নিওরো, যে অ্যানির কিডন্যাপিং-এ জড়িত ছিল, তার ডেডবড়ি পাওয়া গেছে। বুলেটের সাইজ থেকে মনে হয় সেটা বেরেটা থার্টি টু জাতীয় অস্ত্র থেকে এসেছে।
কখন পাওয়া গেছে ডেডবডি?
অল্প কিছু আগে। ঘণ্টাখানেক হবে।
বস ভিকানডিয়া দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বলল, আপনাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে।
পুলিশের লোক সহজে খুশি হয় না, অখুশিও হয় না।
জামশেদকে ধরবার কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
এসব পুলিশের ব্যাপার। ও নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ না করাই ভালো।
আমার মনে হচ্ছে পুলিশ ওকে ধরবার কোনোরকম চেষ্টাই করছে না। করছে কি?
রিনালো শব্দ করে হাসল। জবাব দিল না।
হ্যালো রিনালো!
রিনালো টেলিফোন নামিয়ে রাখল।
প্রতিটি প্রভাতী সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় নিওরোর মৃত্যুসংবাদ চাপা হল। ছবি ছাপা হল অ্যানির। অ্যানির হত্যাকাণ্ড ও মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কীভাবে সাজা পাচ্ছে সে-বিবরণ লেখা হল। শুধুমাত্র জামশেদের কোনো ছবি নেই। তার চেহারার কোনো বিবরণও নেই। একটি পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়েল লেখা হল জামশেদকে নিয়ে। সম্পাদক লিখলেন–আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কখনো সমর্থন করি না। যারা আইন নিজের হাতে নেয় তারা আমাদের কাছে অপরাধী। কিন্তু যখন দেখি বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে, আইন অপরাধীদের স্পর্শ করে না তখন ব্যথিত হই। সে সময় কোনো সাহসী মানুষ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তখন তাকে সমর্থন না করলেও একধরনের শ্রদ্ধা ও মমতা বোধ করি তার জন্যে। সেও অপরাধী। কিন্তু অপরাধী হলেও তাকে ঘৃণা করতে আমাদের বিবেক সায় দেয় না। আমরা আশা করছি আমাদের জীর্ণ পুলিশবাহিনী জামশেদের ঘটনা থেকে একটা বড় শিক্ষা গ্রহণ করবে। তাদের ভবিষ্যৎ কর্মধারী এরকম হবে যেন আমাদের অপরাধীদের ওপর আস্থা স্থাপন করতে না হয়।