টয়লেট থেকে বেরুতেই বেঁটে লোকটা বলল, এখন থেকে যা বলব শুনবে। নয়তো সেফটিপিন দিয়ে তোর চোখ গেলে দেব।
অ্যানি বহু কষ্টে কান্না সামলাল। এখান থেকেই ওরা অ্যানির বাবাকে টেলিফোন করল। এবং একসময় অ্যানিকে বলল বাবার সঙ্গে কথা বলতে।
মামণি, তুমি ভালো আছ?
হ্যাঁ।
ওরা তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে না তো?
অ্যানি শুনল তার বাবা কাঁদতে শুরু করেছে। সে কোনোদিন তার বাবাকে কাঁদতে শোনেনি। তার বুক ব্যথা করতে লাগল। টেলিফোন কেড়ে নেয়া হল এই সময়। বেঁটে লোকটা বলল, তোমাকে আমরা পাশের ঘরে রেখে যাব। চিক্কার চাচামেচিতে কোনো লাভ হবে না–কেউ শুনতে পাবে না। তোমার হাত-পা অবিশ্যি বাধা থাকবে, বুঝতে পারছ?
পারছি।
তবে ভয়ের কিছু নেই। ঘণ্টা দুএকের মধ্যে তুমি ছাড়া পাবে। ঠিক আছে?
অ্যানি জবাব দিল না।
তুমি কি কিছু খাবে?
না।
ভালো।
লোকগুলি উঠে দাঁড়াতেই অ্যানি বলল, আমার সঙ্গে যে কালো রঙের একজন ছিল, তাকে তোমার গুলি করেছ, সে কি বেঁচে আছে?
জানি না।
এটা কোন জায়গা?
তা দিয়ে তোমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
তোমরা কি আমাকে মেরে ফেলবে? আমার এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছিল।
লোকগুলি হেসে উঠল যেন খুব একটা মজার কথা।
.
ডঃ জন নানের ধারণা ছিল না যে একরম গুরুতর আহত একজন মানুষ সেরে উঠতে পারে। তিনি বেন ওয়াটসনকে বললেন, আপনার এই বন্ধুটির জীবনীশক্তি অসাধারণ। এবং আমার মনে হচ্ছে সে সেরে উঠবে।
ধন্যবাদ, ডাক্তার। সে কি আগের মতো চলাফেরা করতে পারবে?
তা বলা কঠিন।
আমি কি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি?
আপনার বন্ধু কথা বলতে পারবে কি না জানি না। তবে আপনি দেখা করতে পারবেন।
হ্যালো, জামস! চিনতে পারছ?
জামশেদ উত্তর দিল না। তার চোখে অবিশ্যি কয়েকবার পলক পড়ল।
ডাক্তার বলছে তুমি সেরে উঠবে। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
জামশেদ মাথা নাড়াল।
খুব কষ্ট হচ্ছে?
জামশেদ চুপ করে রইল।
অবশ্য কষ্ট হলেও তুমি স্বীকার করবে না, তোমাকে আমার চিনতে বাকি নেই। হা হা হা।
নার্স এসে বেন ওয়াটসনকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
যাবার আগে সে ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, আমি থাকব হাসপাতালের আশপাশেই, কোনো চিন্তা নেই।
জামশেদের ভাবলেশহীন মুখেও ক্ষীণ একটি হাসির রেখা দেখা গেল।
জামশেদের জবানবন্দি নেবার জন্যে পুশিশের যে অল্পবয়স্ক অফিসারটি লাউঞ্জে বসে ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে অনেকবার চলে যেতে বলল। রুগির কথা বলার মতো অবস্থা নয়। গুলি লেগেছে দু-জায়গায়, ডান ফুসফুসের নিচের অংশে এবং তলপেটে। তলপেটের জখমটিই হয়েছে মারাত্মক। ভাগ্যক্রমে বুলেট ছিল বত্রিশ ক্যালিবারের। এর চেয়ে ভারী কিছু হলে আর দেখতে হত না। রুগি যে এখন পর্যন্ত ঝুলে আছে তার কারণ লোকটির অসাধারণ প্রাণশক্তি। কথা বলার মতো অবস্থা তার আদৌ হবে কি না কে জানে? কিন্তু পুলিশ অফিসারটি দিনে চার-পাঁচবার করে আসছে। ডাক্তার দেখা হবে না বলা সত্ত্বেও বসে থাকছে।
তৃতীয় দিনে সে রুগির সঙ্গে কথাবার্তা বলার অনুমতি পেল। ডাক্তার জন নানা বারবার বললেন, খুব কম কথায় সারবেন। মনে রাখবেন, লোকটি গুরুতর অসুস্থ।
জামশেদ চোখ মেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল পুলিশ অফিসারটির দিকে।
আজ কি একটু ভালো বোধ করছেন?
জামশেদ মাথা নাড়ল।
আপনি জানেন না, যে-তিনটে লোক মারা গেছে তাদের ধরবার জন্য পুলিশবাহিনী গত চার বছর ধরে চেষ্টা করছে। এরা মাফিয়াচক্রের সঙ্গে জড়িতএই লোক তিনটির নামে গোটা দশেক খুনের মামলী আছে। এরা বন্দুক চালাতে দারুণ ওস্তাদ। অবিশ্যি আপনি নিজেও একজন ওস্তাদ।
জামশেদ ম্লান হাসল। থেমে থেমে বলল, ওরা আমার জন্যে প্রস্তুত ছিল না বলে এরকম হয়েছে। ওরা কোনো প্রতিরোধ আশা করেনি।
তা ঠিক। ওরা কল্পনা করেনি অব্যর্থ নিশানার একজন-কেউ লাফিয়ে পড়বে। পুলিশ অফিসার হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। আমার স্ত্রী আপনাকে চিনতে পেরেছে। আপনার ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। সেটা দেখে চিনল। একবার আপনি তাকে সাহায্য করেছিলেন আপনার কি মনে আছে?
জামশেদ কিছু মনে করতে পারল না।
একবার এক রেস্টুরেন্টে একটা মাতালের পাল্লায় পড়েছিল সে। আপনি তার সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন।
মনে পড়েছে।
আমরা এই ঘটনার কিছুদিন পরই বিয়ে করি। আমার স্ত্রীর খুব ইচ্ছা ছিল বিয়েতে আপনাকে নিমন্ত্রণ করার, কিন্তু আপনার ঠিকানা আমরা জানতাম না।
জামশেদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল।
পুলিশ অফিসার বলল, আপনাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। কিন্তু এখন আর বিরক্ত করব না। শুধু এটুকু বলে যাচ্ছি যে আপনার নিরাপত্তার জন্যে ভালো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুজন সশস্ত্র পুলিশ আপনাকে পাহারা দিচ্ছে।
জামশেদ ক্লান্ত স্বরে বলল, মেয়েটির খোঁজ পাওয়া গেছে?
না, এখনও পাওয়া যায়নি। মেয়ের বাবার বিশেষ অনুরোধে পুলিশ খোঁজখবর করছে না। আমরাও মেয়েটির নিরাপত্তার কথা ভেবে চুপ করে আছি।
টাকা দেয়া হয়েছে? আপনি কিছু জানেন?
আমার যতদূর মনে হচ্ছে টাকা দেয়া হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে আমরা কিছু বলতে পারছি না। মেয়ের বাবা আমাদের পরিষ্কার কিছু বলছে না।
১০.
অ্যানির মনে হল হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সে অনন্তকাল ধরে এখানে পড়ে আছে। সে মনে-মনে অনেকবার বলল—আমি কাঁদব না, কিছুতেই কাঁদব না।