এই সময়ে সবুজ ওপেল গাড়িটি থেকে আরো দুজন লোক বন্দুক-হাতে লাফিয়ে নামল। কালো লোকটি ছুটন্ত অবস্থাতেই গুলি ছুড়ল। এরকম অব্যর্থ হাতের নিশানা কারো থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। লোক দুটিকে নিমিষের মধ্যে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম।
কালো লোকটি বুনো মোষের মতো ছুটছিল। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। সবুজ গাড়িটির দরজা খুলে লম্বা-চুলের একটা লোক কয়েক পশলা গুলি করল কালো লোকটিকে। আমি দেখলাম কালো লোকটি উবু হয়ে পড়ে গিয়েছে।
লা বেলে পত্রিকাটিতে দুটি ছবি ছাপা হয়েছে। একটি অ্যানির, অন্যটি জামশেদের। জামশেদ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে অসম্ভব সাহসী এই লোকটি মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সেন্ট্রাল হাসপাতালে তাকে রাখা হয়েছে কড়া পুলিশ নিরাপত্তায়। ডাক্তাররা ইতিমধ্যে দুবার তার ফুসফুসে অস্ত্রোপচার করেছে। তৃতীয় দফা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। সেন্ট্রাল হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সচিব জন নান বলেছেন। জামশেদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তবে সম্ভাব্য সকল চেষ্টা চলছে।
অ্যানির ছবির নিচে তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে অ্যানি ভিকি হচ্ছে বিখ্যাত সিল্ক ব্যবসায়ী অ্যারন ভিকির নাতনি। তার বয়স বারো বছর এবং তার মুক্তির জন্যে এক মিলিয়ন ইউ এস ডলার মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে।
অ্যানির যে-ছবিটি ছাপা হয়েছে সেটি তার গত জন্মদিনের ছবি। মাথায় হ্যাপি বার্থডে টুপি। মুখভরতি হাসি। ছবিটিতে অ্যানিকে দেবশিশুর মতো লাগছে।
বেন ওয়াটসন খবরটি দুবার পড়ল। তার ভ্র কুঞ্চিত হল। ছবিটিতে যে কালোমতো লোকটিকে দেখা যাচ্ছে, সে যে জামস এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের ছাড়াছাড়ি হয় লিসবনে, প্রায় পনেরো বছর আগে। পনেরো বছর দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে পুরানো অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, শুধু জামস-এর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বেন ওয়াটসন লাসানিয়া ও পিজা হাউজ থেকে বেরুল রাত এগারোটায়। তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট ও বিষণ্ন। জামস বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেন ওয়াটসনকে জানাল, রুগির অবস্থা ভালো নয় এবং যেহেতু রুগি ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে সেহেতু দেখা হবে না। বেন ওয়াটসন সারারাত হাসপাতালের লাউঞ্জে বসে কাটাল। জামস বোধহয় এ-যাত্রা টিকবে না।
ভোরবেলায় জানা গেল ফুসফুসে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তৃতীয় অপারেশন হল ভোর সাতটায়।
০৮.
এক মিলিয়ন ইউ এস ডলার পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি সুটকেস ভরতি করে দশ ডলারের নোটের বান্ডিল যথাসময়ে দেয়ায় কোনোরকম ঝামেলা হয়নি। সুটকেসভরতি ডলার এতরাতে দেয়া হয়েছে। এবং টাকা দেবার এক ঘণ্টার ভেতর ভিকি টেলিফোন পেয়েছে যে অ্যানিকে রাত নটার আগেই ফোরটিনথ অ্যাভিনিউর মোড়ে একটি কমলা রঙের সিডান গাড়ির (যার নম্বর এফ ২৩৪) পেছনের সিটে পাওয়া যাবে। ওরা টেলিফোনে অ্যানির গলাও শুনিয়েছে। অ্যানি বলেছে, সে ভালো আছে এবং কেউ তার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। অ্যানি জামশেদের কথাও জানতে চেয়েছে। জামশেদ এখনও বেঁচে আছে শুনে খুশি হয়েছে।
ভিকি সন্ধ্যা থেকেই ফোরটি আভিনিউর মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত এগারোটা বেজে গেল কারোর দেখা পাওয়া গেল না।
সে বেশ কয়েকবার এতরাকে টেলিফোন করল। কেউ ফোন ধরল না। ভিকির বুক কাঁপতে লাগল। রাত যতই বাড়তে লাগল একধরনের শীতল ভীতি তাকে কুঁকড়ে দিতে লাগল। অ্যানি বেঁচে আছে তো? আদরের অ্যানি, ছোট্ট অ্যানি সোনা।
০৯.
ঠিক কঘন্টা পার হয়েছে অ্যানির মনে নেই। সে মনে রাখার চেষ্টাও করেনি। চিন্তা করতে পারছে না। অনেক কিছুর মতো চিন্তা করবার শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো স্মৃতি নেই মাথায়। শুধু মনে আছে বুড়ো ভালুক ডান হাতে পিস্তল নিয়ে দৈত্যের মতে ছুটে আসছিল। কী ভয়াবহ কিন্তু কী চমৎকার ছবি! একসময় ছবিটি নষ্ট হয়ে গেল। জামশেদ গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
এ্যাই মেয়ে, কিছু খাবে?
বলেছি তো আমি কিছু খাব না।
ঠিক আছে।
অ্যানি লক্ষ করল লোক তিনটি তার সঙ্গে মোটামুটি ভদ্র ব্যবহার করছে। প্রথম তাকে নিয়ে গেছে শহরের বাইরে, একটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে। সে-বাড়িতে বুড়োমতো একজন লোক বসে ছিল, অ্যানিকে দেখেই সে ফুঁসে উঠে বলল, এর জন্যে আমার সেরা তিনটি মানুষ মারা গেছে।
অ্যানির সঙ্গের লোকটি তার উত্তরে বিদেশী ভাষায় বুড়োকে কী কী যেন সব বলল। অ্যানি কিছুই বুঝল না। অ্যানিরা সেখানে ঘণ্টাখানেক থেকে আবার রওনা হল। অ্যানিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল একটি বদ্ধ ওয়াগনে করে। কোথায় যাচ্ছে, অ্যানি কিছুই বুঝতে পারল না। অ্যানির সঙ্গে যে বেঁটেমতো লোকটি ছিল সে একসময় বলল, তুমি ছাড়া পাবে শিগগিরিই। ভয়ের কিছু নেই।
অ্যানির ঠোঁট টেপ দিয়ে আটকানো, সে এর জবাবে কিছু বলতে পারল না। লোকটি থেমে থেমে বলল, মেয়ে হিসেবে তুমি অত্যন্তু লোভনীয় কিন্তু কড়া নির্দেশ আছে, আমাদের কিছুই করবার নেই।
যাত্রাবিরতি হল একটি হোটেলজাতীয় স্থানে। অ্যানিকে বলা হল হাতমুখ ধুয়ে নিতে।
অ্যানি মাথা নাড়ল। সে কিছুই করতে চায় না। হঠাৎ বেঁটে লোকটি এসে প্রকাণ্ড একটি চড় কষাল। অ্যানি হতভম্ব হয়ে গেল। সে নিঃশব্দে হাতমুখ ধুয়ে এল। বাথরুমে আয়নায় দেখল তার বাঁ গাল লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।