জামশেদের মনে হল, লোকটা বিশেষ চিন্তিত। সিগারেট ধরাবার সময় তার হাত কাপছিল। এর কারণ কী?
বলো কী বলবে।
না, তেমন কিছু নয়। ভিকি অস্পষ্টভাবে হাসল।
জামশেদ বলল, তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।
না, চিন্তিত না। চিন্তিত হবার কী আছে?
ভিকি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। ফ্যাকাশেভাবে হেসে বলল, এবার বেশ গরম পড়বে, কী বল?
জামশেদ জবাব দিল না।
ভিকি ইতস্তত করে বলল, তোমাকে একটি কথা বলতে চাই। ইয়ে, মানে, তেমন জরুরি কিছু নয়।
বলো।
ধরো যদি এমন পরিস্থিতি হয় যে তুমি দেখছ কেউ অ্যানিকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছে, তখন আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হবে তুমি যদি চুপচাপ থাক।
কেন?
না, মানে–তুমি যদি গুলি করতে শুরু কর তা হলে বুলেট অ্যানির গায়ে লাগার সম্ভাবনা, ঠিক না?
আশঙ্কা যে একেবারে নেই তা নয়। তবে ভিকি, আমাকে রাখা হয়েছে অ্যানির নিরাপত্তার জন্যে, ঠিক না?
হ্যাঁ, তা ঠিক।
তুমি নিশ্চয়ই আশা কর না এরকম পরিস্থিতিতে আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকব।
না, তা কেন? তা তো হতেই পারে না। ভিকি আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল।
জামশেদ বলল, তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত?
না না, চিন্তিত হব কেন? ভিকি দূর্বলভাবে হাসল।
জামশেদ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না। ভিকি কিছু-একটা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত।
.
রুনের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়ল। সাধারণত এসব ছোটখাটো জিনিস তার চোখে পড়ে না। কিন্তু পরিবর্তনটি হঠাৎ এবং স্পষ্ট। চোখে না পড়ে উপায় নেই। তার ওপর কদিন আগে ভিকি দুটি প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ান কুকুর কিনে এসেছে। এর কারণ বোধগম্য নয়। ভিকি কুকুর পছন্দ করে না। হঠাৎ করে কুকুরের প্রতি তার এরকম প্রেমের কারণ কী? রুন কোনো ব্যাপার নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না। তবু সে এ ব্যাপারটি নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করল। ভিকিকে যে ঠিক ভালো না বাসলেও পছন্দ করে। স্বামী হিসেবে সে চমৎকার। এবং যতদূর মনে হয় মাঝে মাঝে জুয়ার টেবিলে বসা ছাড়া তার অন্য কোনো বদঅভ্যেস নেই।
রুন বিকেলে একটু বিশেষ সাজসজ্জা করল। এ-জাতীয় পোশাকে কুমারী মেয়েদেরকেই ভালো লাগে। কিন্তু রুনকে এখনও কুমারী মেয়ে বলেই ভ্রম হয়। রুন বড় একটি খাম হাতে নিয়ে ভিকির ঘরে উঁকি দিল।
হ্যালো, ভিকি!
হ্যালো।
কী ব্যাপার, তুমি দেখি একেবারে মাছের মতো হয়ে গেছ।
ভিকি জবাব দিল না।
রুন সামনের চেয়ারটিতে বসতে বসতে বলল, খুব সম্ভব গতরাতে তোমার ঘুম হয়নি। চোখ লাল। ব্যাপারটা কী আমি জানতে চাই।
তেমন কিছু না।
বিজনেস নিয়ে চিন্তিত?
হ্যাঁ।
কোনো সুরাহা হয়নি?
না। বুদ্ধিমান এতরা কোনো বুদ্ধি দিতে পারল না?
ভিকি ঈষৎ চমকাল। কিছু বলল না।
রুন গম্ভীর গলায় বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
ভিকি চোখ তুলে তাকাল।
আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দেব। কিন্তু একটি শর্ত আছে।
কী শর্ত?
তুমি তোমার মুখে যে ভয়াবহ চিন্তার মুখোশ পরে আছ এটি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কথাটা বলে রুন খিলখিল করে হেসে উঠল। আর ঠিক তখন টেলিফোন এল। বালজাক অ্যাভিনিউর মোড়ে অ্যানিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ছোটখাটো একটা খণ্ড প্রলয় হয়ে গেছে সেখানে। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে তিনজন মারা গেছে। সংখ্যা এর চেয়ে বেশিও হতে পারে।
এক মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ চেয়ে প্রথম টেলিফোনটি এল রাত এগারোটায়।
এগারোটা পঁচিশে সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এল। জামশেদ নামের যে দেহরক্ষীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে তার অবস্থা সংকটাপন্ন। নিকট আত্মীয়স্বজনদের খবর দেয়া প্রয়োজন।
অ্যানির অপহরণ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে লা বেলে পত্রিকায়। রিপোর্টটিতে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য আছে। মধ্যবয়স্ক এই স্কুল শিক্ষকটি ঘটনার সময় কফিশপে কফি খাচ্ছিলেন। তার চোখের সামনেই সমস্ত ব্যাপার ঘটল।
তার প্রতিবেদনটি ছিল এরকম :
আমি যেখানে কফি খাচ্ছিলাম, আইসক্রিম পার্লারটি ছিল তার সামনে। জুলাই মাসের গরমের জন্যেই খোলা উঠানে কফির টেবিল বসানো হয়েছিল। আমি আমার এক বান্ধবীর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। ঘনঘন তাকাচ্ছিলাম রাস্তার দিকে।
চারটা ত্রিশ মিনিটে নীলরঙা একটি ছোট পুনটিয়াক এসে আইসক্রিম পার্লারে থামল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল অত্যন্ত রূপসী একটি বালিকা। বালিকাটি কাউন্টারে আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে যখন অপেক্ষা করছিল তখন আমি লক্ষ করলাম একটি প্রকাণ্ড সবুজ রঙের ওপেল গাড়ি আইসক্রিম পার্লারের পশ্চিমদিকে থামল।
তিনটি লোক নেমে এল গাড়ি থেকে। দুজন ছুটে গেল মেয়েটির দিকে, তৃতীয়জন ফাঁকা আওয়াজ করতে লাগল। তার হাতে হালকা একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। গুলি ছুড়বার আগ পর্যন্ত আমি তা লক্ষ করিনি।
গুলির শব্দ আসামাত্র চারদিকে ছুটাছুটি শুরু হল। আমি নিজেও উঠে দাঁড়ালাম। কফিশপের মালিক চেঁচিয়ে বলল–সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ুন। বিপদের সময় কারোর কিছু মনে থাকে না। আমারও থাকল না। আমি দৌড়ে খোলা রাস্তায় এসে পড়লাম। তখন বাচ্চা মেয়েটিকে দুজন ওপেল গাড়িটির দিকে টেনে নিচ্ছে এবং মেয়েটি চাঁচাচ্ছে প্রাণপণে। যে-দুজন মেয়েটিকে টানছে তাদের একজন মেয়েটির গালে চড় কষাল। এই সময় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র-হাতে তৃতীয় ব্যক্তিটিকে দেখালাম মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম কালো রঙের একটি মানুষ ওদের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মানুষটির বা হাতে একটি পিস্তল।