সতেরো তারিখ। তোমাকে তো বলেছি আগে।
তুমি কিসে কিসে আছ?
একশো মিটার দৌড়।
আর কিছুতে না?
না। তুমি যাচ্ছ তো মা?
রুন ইতস্তত করে বলল, খুব চেষ্টা করব আমি, কিন্তু …
অর্থাৎ যাচ্ছ না। আমি আগেই জানতাম যাবে না।
এর মানে কী? তুমি আগেই জানতে মানে?
মানে কিছু নেই। তোমরা কেউ যাবে না তা আমি আগেই জানতাম। অ্যানি থালা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ডিনার শেষ করো অ্যানি।
আমার খিদে নেই।
অ্যানি, তোমার বয়স হচ্ছে। এখন তুমি আর ছেলেমানুষ নও। সবার সুবিধা অসুবিধা তোমার বুঝতে পারা উচিত।
অ্যানি জবাব না দিয়ে ছুটে চলে গেল নিজের ঘরে। মারিয়া টেবিল থেকে খালা সরাতে সরাতে বলল, অ্যানি এবার একশো মিটার স্পোর্টসে প্রাইজ পাবে।
তা-ই বুঝি?
হ্যা, ম্যাডাম। ঐ লোকটি খুব ভালো শেখায়।
দৌড়ানোর মধ্যে আবার শেখানোর কী আছে?
তা জানি না, তবে লোকটি যত্ন করে শেখাচ্ছে।
রুন গম্ভীর হয়ে গেল।
মারিয়া হঠাৎ বলল, লোকটি খুব খারাপ না ম্যাডাম।
খারাপ হবে কেন?
না, মানে লোকটি অ্যানিকে পছন্দ করে।
রুন চোখ তুলে তাকাল।
মারিয়া কফি ঢালতে ঢালতে বলল, অ্যানির যে-রাতে জ্বর এল, সে-রাতে একবার সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে জ্বর কত?
তা-ই বুঝি?
হুঁ। ওর কাছ থেকে তা আশা করা যায় না, ঠিক না ম্যাডাম?
.
জামশেদ সারা দুপুর একটা বই পড়তে চেষ্টা করছে, দি ইয়েলো নাই! পড়া মোটেও আগাচ্ছে না। অভ্যেস না থাকলে যা হয়। বইটির কভারে লেখা আছে এই সত্যি ভূতের গল্প কেউ যেন রাতে না পড়ে। যাদের ব্লাডপ্রেশার বা হার্টের অসুখ আছে তারা যেন ভুলেও এ-বই না পড়ে। জামশেদ বহু কষ্টে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে এবং যতই এগুচ্ছে ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এমন সব আজগুবি জিনিসও লেখা হয় এবং লোকজন কিনে এনে পড়ে। একটি একুশ বছরের মেয়ের সঙ্গে প্রতিরাতে একটি পিশাচ এসে ঘুমায়। গাঁজাখুরিরও সীমা থাকা দরকার। জামশেদ বই বন্ধ করে বিরক্তমুখে বারান্দায় চলে এল। তার প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। এমন তৃষ্ণা যা সময়-অসময় মানে না, হঠাৎ জেগে উঠে চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলে। কিন্তু এখন যদি দরজা বন্ধ করে বোতল খুলে বসে তা হলে আর নিজেকে সামলানো যাবে না। জামশেদ প্রাণপণে তৃষ্ণা ভুলে থাকতে চেষ্টা করল। ব্যস্ত থাকলে কাজ হবে হয়তো। সে নিচে নেমে এল। লনের এক প্রান্তে অ্যানি বসে ছিল। তার বসায় ভঙ্গিটি অদ্ভুত–যেন কঁদছে। এবং কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। জামশেদ একবার ভাবল তাকে ডাকবে না। তবু ডাকল এবং আশ্চর্য, ডাকল খুব নরম স্বরে, কী করছ, অ্যানি?
কিছু করছি না।
কাঁদছিলে নাকি?
অ্যানি তার জবাব না দিয়ে বলল, তুমি কি কাল আমার স্পোর্টস দেখবে, না গাড়িতে বসে থাকবে?
লোকজনের ভিড় আমার পছন্দ হয় না। আমি গাড়িতে থাকব।
জামশেদের কথা শেষ হবার আগেই অ্যানি প্রায় ছুটে চলে গেল। সারা বিকেল এবং সারা সন্ধ্যা তার আর দেখা পাওয়া গেল না।
রাত দশটায় জামশেদ রান্নাঘরে উঁকি দিল। মারিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। জামশেদকে কখনো এখানে আসতে দেখা যায় না। সে অবাক হয়ে বলল, কী, কফি খাবে? কফির জন্যে এসেছ?
না। অ্যানি কোথায়?
ঘুমুতে গেছে।
ঘুমিয়ে পড়েছে?
না, এখনও ঘুমায়নি। আমি দুধ নিয়ে যাব। দুধ খেয়ে শোবে।
জেগে আছে তা হলে?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার? কিছু বলবে অ্যানিকে?
তুমি অ্যানিকে বলবে যে আমি ওর স্পোর্টস দেখতে যাব।
মারিয়া বলল, আমি এক্ষুনি ওকে বলছি।
এক্ষুনি বলার দরকার নেই।
মারিয়া বলল, আমি খুব খুশি হয়েছি যে তুমি যাচ্ছ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক। অ্যানি মেয়েটি খুব নিঃসঙ্গ।
জামশেদ জবাব দিল না, গম্ভীরমূর্খ উপরে উঠে এল।
.
একশো মিটার দৌড় হচ্ছে তিন নম্বর ইভেন্ট। অ্যানি খুব নার্ভাস হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রতিযোগী পাঁচজন। এদের মধ্যে নিন্তি নামের মেয়েটি হরিণের মতো দৌড়ায়।
মাঠে নামবার আগে জামশেদ বলল, যখন দৌড়াতে শুরু করবে তখন একটি জিনিসই শুধু খেয়াল রাখবে। সামনের লাল ফিতা। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
ভয় লাগছে?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে আমি হেরে যাব।
কাউকে তে হারতেই হবে।
আমার হারতে ভালো লাগে না।
স্টার্টিং ফায়ার হতেই অ্যানি বিদ্যুতের মতো ছুটল। জামশেদ হাসল,–চমৎকার স্টাটিং! অপূর্ব!! অ্যানি নিমেষের মধ্যে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে দিল। কিন্তু অঘটন ঘটল–অ্যানি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। একটা হাহাকার উঠল দর্শকদের প্যাভিলিয়ন থেকে। অ্যানির আশাহত চোখের সামনে প্রতিযোগীরা ছুটে বেরিয়ে গেল। লাফিয়ে উঠল জামশেদ–উঠে দাঁড়াও, দৌড়াও বোকা মেয়ে, দৌড়াও।
অ্যানি উঠে দাঁড়িয়েছে।
জামশেদ তৃতীয়বার চেঁচাল, দৌড়াও।
অ্যানি ছুটতে শুরু করল। পৌঁছাল সবার শেষে।
অ্যানি কাঁদতে কাঁদতে দর্শকদের প্যাভিলিয়নের দিকে আসছে। জামশেদ এগিয়ে গেল। একটি ছোট্ট শিশুর মতো অ্যানি জমিশেদকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।
বাড়ি ফেরার পথে জামশেদ বলল, আমি খুব খুশি হয়েছি যে পড়ে যাবার পরও তুমি উঠে দাঁড়িয়েছ এবং দৌড়াতে শুরু করেছ।
তাতে কিছুই যায় আসে না।
তাতে অনেক কিছুই যায় আসে, অ্যানি।
অ্যানি ফ্রকের হাতায় চোখ মুছল। জামশেদ বলল, পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। খুব অল্প কিছু মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারে।