জামশেদ উঠে এগিয়ে গেল। খুব ঠাণ্ডাস্বরে, বলল, মেয়েটিকে ছেড়ে দাও।
কেন? তুই ফুর্তি করতে চাস?
ওর হাত ছাড়ো।
মাতালটা হাত ছেড়ে দিল কিন্তু নিমিষেই বাঁ হাতে ছোরাটা তুলল। তোলার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ছোরা সে অতীতে অনেকবার ব্যবহার করেছে। আজকেও করবে। কারণ মদের প্রভাবে তার বুদ্ধি ঘোলা হয়ে গেছে।
জামশেদ দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করল। ছোকরা লেফট হ্যাল্ডার কি না তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ধোকায় ফেলবার জন্যে এই কাণ্ডটি করা হয়। আক্রমণের ঠিক আগের মুহূর্তে ছোরা চলে আসে ডান হাতে।
জামশেদ একদৃষ্টে মাতালটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষার মতো কষ্টকর কিছুই নেই। তা ছাড়া বয়সের জন্যে ইন্দ্রিয় আগের মতো সজাগ রাখা যায় না। জামশেদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। এগিয়ে আসছে, এখন ঝাঁপিয়ে পড়বে। যা ভাবা গিয়েছিল তা-ই, সে তার ডান হাতটিই ব্যবহার করবে। ধোঁকা দেবার উদ্দেশ্যেই বাঁ হাতে রেখেছে ছুরি। হাতবদল হবার আগমুহূর্তেই কিছু-একটা করতে হবে।
মেয়েটি কুলকুল করে ঘামছিল। সে দেখল, ছুরি-হাতে বাঘের মতো বয়স্ক লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাতালটি। মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ মেলে যে-দৃশ্য দেখল তার জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। দেখল বয়স্ক লোকটি নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। চার-পাঁচ ফুট দূরে চিত হয়ে পড়ে আছে মাতালটি। খুব সম্ভব তার নাক ভেঙে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। সে দারুণ অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বয়স্ক লোকটিকে।
জামশেদ তার টেবিলে ফিরে আসতেই ছেলেটি দৌড়ে এল।
স্যার, ভালো কনিয়াক আছে, দেব?
না। টাকা লাগবে না।
না। আমি এখন উঠব।
স্যার, আপনি যদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন তা হলে বেনের সঙ্গে দেখা হবে। বেন ওয়াটসন একটার দিকে আসবে।
জামশেদ উঠে দাঁড়াল।
স্যার, একটু যদি বসেন।
না, এখন আমি যাব।
বেন ওয়াটসনকে আপনার কথা কী বলব?
কিছু বলতে হবে না।
আপনার নাম?
আমার নাম বলার কোনো প্রয়োজন নেই।
আপনি কি আবার আসবেন?
হ্যাঁ, আসতে পারি। না-ও আসতে পারি।
জামশেদ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই মেয়েটিকে দেখতে পেল। সে খুব সম্ভব জামশেদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। জামশেদকে বের হতে দেখেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এল। আমি আপনাকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
ধন্যবাদ দেবার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি কি আপনার নাম জানতে পারি?
জামশেদ সেকথার উত্তর না দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, মেয়েদের এত রাতে এক একা বাইরে থাকাটা ঠিক না।
আমি আমার এক বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমার বন্ধু একজন পুলিশ অফিসার।
ও
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। শুভ রাত্রি।
শুভ রাত্রি।
রুন কখনো সকালে উঠতে পারে না
০৫.
রুন কখনো সকালে উঠতে পারে না।
নটার সময় বেড-টি খেয়ে সে খবরের কাগজ পড়তে বসে। খেলাধুলা এবং আইন আদালত এই দুটি অংশ পড়তে পড়তে দশটা বেজে যায়। রোজই সে দাঁত ব্রাশ করতে যায় দশটার পর।
আজ একটা বিচিত্র কারণে রুটিনের ব্যতিক্রম হল। শেষরাতের দিকে রুন একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখল। যেন সে এবং অ্যানি সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়েছে। কিন্তু অ্যানির গায়ে কোনো কাপড় নেই। সে খুব বিরক্ত হয়ে বলছে, এইসব কী অসভ্যতা, অ্যানি। ছি!
ঠিক তখন অ্যানি ভয়-পাওয়া স্বরে বলল, মা, পালাও! ওরা আমাদের ধরতে আসছে।
রুন চমকে পিছনে ফিরে দেখল তিনটি বদ্ধ উন্মাদ ছুটে আসছে তাদের দিকে। ওদের গায়েও কোনো কাপড় নেই। রুন দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু অ্যানি সেরকম দৌড়াতে পারছে না। পাগলগুলো শেষ পর্যন্ত অ্যানিকে ধরে ফেলল। রুন শুনল, অ্যানি প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, জামশেদ আমাকে বাচাও।
রুন এই সময় জেগে উঠল। পরপর দুপেগ ব্রান্ডি খেয়ে বাইরে এসে দেখল ভোর হয়েছে। অ্যানি জগিং সুট পরে দৌড়াচ্ছে বাড়ির সামনের খোলা মাঠটায়। রুন একবার ভাবল অ্যানিকে ডাকে। কিন্তু ডাকল না। রেলিঙে ভর দিয়ে তাকিয়ে রইল, স্বপ্নের ঘোর তার তখনও কাটেনি। এখনও গা কাঁপছে।
রুন দেখল জামশেদ নিচে নেমে যাচ্ছে। হাত-ইশারা করে ডাকছে অ্যানিকে। কী যেন বলছে। উপর থেকে ঠিক শোনা যাচ্ছে না। রুন নিচে নেমে এল। জামশেদ ভারী গলায় উপদেশ দিচ্ছে অ্যানিকে।
তুমি ভালোই দৌড়াচ্ছ, কিন্তু শুরুটা ভালো হচ্ছে না। দৌড়ে শুরুটাই আসল। ঠিক সময় শুরু করতে হবে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হবে।
অ্যানি বলল, তুমি কি আমাকে শেখাবে? আমি জানি আমি ভালো দৌড়াতে পারি, কিন্তু শুরুটা আমার সত্যি সত্যি খারাপ।
রুন দেখল জামশেদ গম্ভীর হয়ে আছে। এই লোকটি কি সহজ হতে জানে না?
আমাকে তুমি শেখাবে? প্লিজ।
হ্যাঁ, শেখাব। এসো আমার সঙ্গে।
রুন লক্ষ করল অ্যানির সমস্ত চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এসব মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। মেয়েটি ক্রমে ক্রমেই অপরিচিত এই ভয়ংকর লোকটির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
.
রুন ভিকিকে টেলিফোন করল দুপুরে। ভিকি টাকাপয়সার কী-একটা সুরাহা করবার জন্যে রোমে গিয়েছে। গতকালই ফেরার কথা ছিল, ফেরেনি।
হ্যালো, ভিকি?
হা। কী ব্যাপার?।
গতকাল রাতে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
তা-ই নাকি?
হ্যাঁ। শোনো কী দেখলাম…
ভিকি ভ্রূ কুঁচকে শুনতে লাগল। লং ডিসটেন্স কল। প্রচুর বিল উঠবে কিন্তু উপায় নেই, শুনতেই হবে। স্বপ্নের কথা ভিকিকে দশ মিনিট ধরে শুনতে হল। সবশেষে রুন বলল, আমার খুব ভয় লাগছে।