হ্যাঁ, তা বলেছি। কিন্তু টেম্পোরারি অ্যাপয়েন্টমেন্টেও তিনমাস শেষ হবার আগে নোটিস দেয়া যায় না। তুমি এত ব্যস্ত হয়ে উঠলে কেন?
এতরা খুব রাগ করেছে। একে তো এতরাই জোগাড় করে এনেছিল। এতরা আমাকে বলেছে ঐ লোকটি না বিদেয় হওয়া পর্যন্ত সে এ-বাড়িতে আসবে না।
না আসুক। তার আসতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?
তার মানে? কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি?
কিছুই বোঝাতে চাচ্ছি না। ভোর হোক তখন দেখা যাবে। এখন ঘুমাও! অসংখ্য ঝামেলা আমার মাথায়। এইসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে হৈচৈ করতে ভালো লাগছে না।
তোমার আবার কী ঝামেলা?
ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া যাচ্ছে না। একটা থেকে না পাওয়া গেলে অন্যটা থেকে পাওয়া যাবে। ভিকি কথা না বাড়িয়ে ঘুমুতে গেল। রুন মাথার চুল আঁচড়াতে আচড়াতে বলল, ঐ লোকটি মনে হল অ্যালকোহলিক। মারিয়া জানালা দিয়ে দেখেছে রাতের বেলা বোতল নিয়ে বসে ও।
এটুআধটু ড্রিংক তো সবাই করে।
তা করে, কিন্তু কেউ দরজা-টরজা লাগিয়ে করে না। আমি এ-বাড়িতে কোনো মাতালকে রাখব না।
সকাল হোক, আলাপ করে ঠিক করব কী করা যায়। এখন দয়া করে ঘুমুতে যাও।
.
টুক টুক করে টোকা পড়ছে দরজায়। জামশেদ ভারীস্বরে বলল, কে?
আমি। আমি অ্যানি।
কী চাই?
আমি তোমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি।
ঠিক আছে। এবার যাও।
আমি তোমার জন্য কয়েকটা গোলাপ ফুল এনেছিলাম।
ফুল লাগবে না। তুমি যাও।
অ্যানি তবুও দীর্ঘ সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া কফির পেয়ালা হাতে বাইরে বেরিয়ে দেখল অ্যানি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা তার ভালো লাগল না। একটা ভয়ংকর লোকের দরজার সামনে ভোরবেলায় ফুল-হাতে দাঁড়িয়ে থাকাটা চট করে চোখে লাগে। ব্যাপারটা রুনকে বলতে হবে। মারিয়া ডাকল, অ্যানি!
হ্যালো, মারিয়া।
কী করছ একা একা?
কিছু করছি না।
ফুল কার জন্যে?
অ্যানি হাসিমুখে বলল, বুড়ো ভালুকের জন্যে।
হঠাৎ ফুল কেন? কোনো বিশেষ কারণ আছে?
আছে। তোমাকে বলা যাবে না।
মারিয়ার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগছে না।
.
জামশেদকে একদিনের ছুটি দেয়া হয়েছে।
তার ছুটির প্রয়োজন ছিল না তবু নিতে হল। ভিকি বারবার বলল, ঘুরেটুরে আসো। সারাক্ষণ ঘরে বন্দি হয়ে থাকার দরকার নেই। অ্যানির স্কুল নেই, সে বাড়িতেই থাকবে।
জামশেদের যাবার তেমন জায়গা নেই। মিলান শহরটিকে সে খুব ভালো চেনে না। দশ বছর আগে এখানের অলিগলি চেনা ছিল। এখন আর নেই। দশ বছর খুব দীর্ঘ সময়, এই সময়ে খুব চেনা জিনিসও খুব অচেনা হয়ে যায়।
রাস্তাঘাট বদলে গেছে। শহর অনেক পরিচ্ছন্ন হয়েছে। ডেলকা নদীর দুপাশে বস্তিজাতীয় যেসব ঘরবাড়ি ছিল তাঁর কোনো চিহ্নও নেই। আকাশছোঁয়া দালান উঠেছে দুপাশে। প্রশস্ত ছয় লেনের রাস্তা। ঝলমলে নিওন আলো।
সন্ধ্যার আগে জামশেদ একতলা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। রেস্টুরেন্টটি শহরের উপকণ্ঠে একটি দরিদ্র অঞ্চলে। অল্প আলোর একটি বাতি জ্বলছে। সে-আলোতে রেস্টুরেন্টের নাম অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে–পিজা অ্যান্ড লাসানিয়া হাউস। লেখাটি ইংরেজিতে।
রেস্টুরেন্ট ফাঁকা। এক কোনায় একটি বুড়োমত ভদ্রলোক ঝিমুচ্ছে। অন্য প্রান্তে একটি অল্পবয়েসী মেয়ে একা একা বসে আছে। মেয়েটি ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। নিশ্চয়ই কারো জন্য অপেক্ষা করছে সে।
কাউন্টারে অল্পবয়স্ক একটি ছোকরা বসে আছে। জামশেদ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল, আমি একজন আমেরিকানের খোঁজ করছি, তার নাম বেন ওয়াটসন।
ছেলেটি সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। থেমে থেমে বলল, কীজন্যে খোঁজ করছেন?
ও আমার পরিচিত।
বেন এখানে নেই।
সে এখানে আছে। কখন আসবে সে?
জানি না।
আমি তার জন্যে অপেক্ষা করব।
ইচ্ছা হলে করুন।
জামশেদ একটি অন্ধকার কোনা বেছে নিল বসবার জন্যে। কাউন্টারের ছেলেটি এসে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবে? ভালো পিজা আছে।
না।
কনিয়াক আছে। দেব?
দিতে পার।
লিরা আছে তো তোমার কাছে?
আছে।
এখানে আগে দাম দিতে হয়।
জামশেদ হাজার লিরার একটি নোট বের করল।
ছেলেটি নোট নিতে নিতে বলল, বেন ওয়াটসনের সঙ্গে তোমার কী দরকার?
আছে একটা দরকার।
তুমি কি পুলিশের লোক?
না।
জামশেদ লক্ষ করল মাস্তান ধরনের একটি ছেলে ঢুকেছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না টলছে। ছেলেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির টেবিলের সামনের। নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা বাধাতে চায়। জমিশেদ কানখাড়া করল।
মিস, আমি কি তোমার টেবিলে বসতে পারি?
আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি দয়া করে অন্য টেবিলে বসো।
যার জন্যে অপেক্ষা করছ সে তো আসছে না।
আসবে।
যখন আসবে তখন ছেড়ে দেব।
জামশেদ লক্ষ করল মেয়েটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল।
উঠছ কেন?
আমি অন্য কোথাও বসব।
কেন, আমাকে পছন্দ হচ্ছে না?
পছন্দ অপছন্দে কথা না। আমি বাড়ি চলে যাব।
এখনই বাড়ি যাবে কেন? রাত তো মাত্র শুরু।
কাউন্টারের ছেলেটি বলল, এই, ঝামেলা করবে না।
ঝামেলা?
এটা মাতলামির জায়গা না।
কী, তুই আমাকে মাতাল বললি?
মাতাল-টাতাল বলিনি। যাও, অন্য কোথাও যাও।
এইখানে এই মেয়ের হাত ধরে বসে থাকব, দেখি কোন শালা কী বলে।
লোকটি পকেট থেকে আধহাত লম্বা একটি ছোরা বের করল।
মেয়েটির মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। বুড়ো ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে এই ঝামেলায় থাকতে চায় না। কাউন্টারের ছেলেটিও ভয় পেয়েছে।