যেখানে সমাজ, সেইখানেই দল। যেখানে লোকের বসতি, সেইখানেই গোলযোগ-সেইখানেই পক্ষাপক্ষ; সঙ্গে সঙ্গে হিংসা, শত্রুতা, মিত্রতা, আত্মীয়তা, বাধ্যবাধকতা। যেমন এক হস্তে তালি বাজিবার কথা নহে, তেমনই দলাদলি না থাকিলেও কথা জন্মিবার কথা নহে। কথা জন্মিলেই পরিচয়, স্বপক্ষ বিপক্ষ সহজেই নির্ণয়। সে সময় খুঁজিতে হয় না-কে কোন্ পথে, কে কোন্ দলে।
এজিদ্ দামেস্কের রাজা। প্রজা মাত্রই যে মহারাজগত প্রাণ-অন্তরের সহিত রাজানুগত-সকলেই যে তাহার হিতকারী তাহা নহে, সকলেই যে তাহার দুঃখে দুঃখিত তাহা নহে। দামেস্ক-সিংহাসন পরপদে দলিত হইল ভাবিয়া সকলেই যে দুঃখিত হইয়াছে, সকলের হৃদয়েই যে আঘাত লাগিয়াছে, চক্ষের জল ফেলিয়াছে, তাহাও নহে। অনেক পূর্ব হইতেই হজরত মাবিয়ার পক্ষীয়, প্রভু হাসান-হোসেনের ভক্ত রহিয়াছে। আজ পরিচয়ের দিন, পরীক্ষার দিন। সহজে নির্বাচন করিবার এই উপযুক্ত সময় ও অবসর।
জয় ঘোষণা এবং বিজয়-বাজনার তুমুল রবে নগরবাসীরা ভয়ে অস্থির হইল। কেহ পলাইবার চেষ্টা করিল, পারিল না। কেহ যথাসর্বস্ব ছাড়িয়া জাতি-মান-প্রাণ বিনাশ ভয়ে, দীন দরিদ্রবেশে গৃহ হইতে বহির্গত হইল। কেহ ফকির-দরবেশ, কেহ বা সন্ন্যাসী রূপ ধারণ করিয়া জন্মভূমির মায়া পরিত্যাগ করিল। কেহ আনন্দ-বেগ সম্বরণে অপারগ হইয়া “জয় জয়নাল আবেদীন!” মুখে উচ্চারণ করিতে করিতে জাতীয় সম্ভাষণ, জাতীয়ভাব প্রকাশ করিয়া, গাজী রহমানের দলে মিশিয়া চিরশত্রু বিনাশের বিশেষ সুবিধা করিয়া লইল। কাহারো মনে দারুণ আঘাত লাগিল,-“জয় জয়নাল আবেদীন!” কথাগুলি বিশাল শেলসম অন্তরে বিঁধিয়া পড়িল, কর্ণেও বাজিল। সাধ্য নাই, নগর রক্ষার কোন উপায় নাই; রাজ-বলের কোন লক্ষণই নাই। আর উপায় কি? পলাইয়া প্রাণরক্ষা করাই কর্তব্য; যথাসাধ্য পলায়নের উপায় দেখিতে লাগিল। যাহারা জয়নাল আবেদীনের দলে মিশিল না, কাফের-বধে অগ্রসর হইল না, পলাইবারও উপায় পাইল না, তাহাদের ভাগ্যে যাহা হইবার হইতে লাগিল। বিপক্ষদলের জাতক্রোধে এবং সৈন্যদলের আন্তরিক মহারোষে অধিবাসীরা যন্ত্রণার একশেষ ভোগ করিতে লাগিল। সন্তানসন্ততি লইয়া ত্রস্তপদে যাহারা পলাইতে পারিয়াছিল, প্রকাশ্য পথ ছাড়িয়া গুপ্ত পথে, কোন গুপ্ত স্থানে লুকাইয়া আত্মগোপন করিয়াছিল, তাহারাই রক্ষা পাইল, তাহারাই বাঁচিল। বাড়ি-ঘরের মায়া ছাড়িতে জন্মের মত জন্মভূমি হইতে বিদায় লইতে যাহাদের একটু বিলম্ব হইল, তাহাদের প্রাণবায়ু মুহূর্তমধ্যে অনন্ত আকাশে-শূন্যে শূন্যে উড়িয়া গেল। কিন্তু জন্মভূমির মায়াবশে দেহ দামেস্কেই পড়িয়া রহিল। কার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কে করে! কার কান্না কে কাঁদে! সুন্দর সুন্দর বাসভবন সকল ভূমিসাৎ হইতেছে, ধনরত্ন, গৃহসামগ্রী হস্তে হস্তে চক্ষের পলকে উড়িয়া যাইতেছে। কে কথা রাখে, আর কেই বা শুনে? কোথাও ধূ-ধূ করিয়া অগ্নি জ্বলিয়া উঠিতেছে, দেখিতে দেখিতে সজ্জিত গৃহ সকল জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইতেছে। নগরময় হাহাকার! নগরময় অন্তর্ভেদী আর্তনাদ! আবার মধ্যে মধ্যে আনন্দধ্বনি, বিজয়ের উচ্চ-রব। আবার মাঝে মাঝে কান্নার রোল, আর্তনাদ, কোলাহল, হৃদয়বিদারক “মলেম গেলেম-প্রাণ যায়”-বিষাদের কষ্ট! উহু! এ কী ব্যাপার? ভীষণ কাণ্ড! পিতার সম্মুখে পুত্রের বধ! মাতার বক্ষের উপর কন্যার শিরচ্ছেদ! পত্নীর সম্মুখে পতির বক্ষে বর্শা প্রবেশ। পুত্রের সম্মুখে বৃদ্ধ মাতার মস্তক চূর্ণ! সুদীর্ঘ কৃষ্ণ কেশযুক্ত রমণী-শির, কৃষ্ণ, শুভ্র, লোহিত, ত্রিবিধ রঙ্গের আভা দেখাইয়া পিতার সম্মুখে ভ্রাতার সম্মুখে-স্বামীর সম্মুখে দেখিতে দেখিতে গড়াইয়া পড়িতেছে। কলিজা পার হইয়া রক্তের ফোয়ারা ছুটিয়াছে। কী ভয়ানক ভীষণ ব্যাপার! কত নরনারী ধর্মরক্ষায় নিরাশ হইয়া পাতালস্পর্শী কূপে আত্মবিসর্জন করিতেছে। কেহ অস্ত্রের সহায়ে, কেহ অন্য উপায়ে যে প্রকারে যে সুবিধা পাইতেছে, অত্যাচারের ভয়ে আত্মঘাতিনী হইয়া, পাপীর মস্তকে পাপভার অধিকতররূপে চাপাইতেছে। মরিবার সময় বলিয়া যাইতেছে, “রাজার দোষে রাজ্যনাশ, প্রজার বিনাশ! ফল হাতে হাতে। প্রতিকার কাহার না আছে? রে এজিদ্! রে জয়নাব!!”
সৈন্যদল নগরের যে পথে যাইতেছে, সেই পথেই এইরূপ জ্বলন্ত আগুন জ্বালাইয়া পাষাণহৃদয়ের পরিচয় দিয়া যাইতেছে! দয়ার ভাগ যেন জগৎ হইতে একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। মায়া-মমতা যেন দুনিয়া হইতে জন্মের মত সরিয়া পড়িয়াছে।
কিন্তু এত করিয়াও হানিফার সৈন্যদিগের হিংসার নিবৃত্তি হইতেছে না। এত অত্যাচার, এত রক্তধারেও সে বিষম-তৃষ্ণা নিবারণ হইতেছে না। এত করিয়াও শত্রু-বধ-আকাক্সক্ষা মিটিতেছে না! মদিনার বীরগণ করুণস্বরে বলিতেছে-“আম্বাজী সৈন্যগণ! গঞ্জামের ভ্রাতৃগণ! তোমরা মনে মনে ভাবিতেছ যে, আমরা সময় পাইয়া শত্রুর প্রতি অন্যায়-অত্যাচার করিতেছি। ভাই ভাবিয়া দেখিবে-একটু চিন্তা করিয়া দেখিবে-তাহা নহে। এজিদ্ মদিনাবাসীদিগের প্রতি যেরূপ অত্যাচার যেরূপ ব্যবহার করিয়াছে, তাহার প্রতিশোধ এখনো হয় নাই। অস্ত্রের আঘাতে কতদিন শরীরে বেদনা থাকে? ভ্রাতৃগণ! এরূপ অনেক আঘাত হৃদয়ে লাগিয়াছে যে সে বেদনা দেহ থাকিতে উপশম হইবে না, প্রাণান্ত হইলেও প্রাণ হইতে সে নিদারুণ আঘাতের চিহ্ন সরিয়া যাইবে কি না জানি না। আপনারা চক্ষে দেখেন নাই, বোধ হয় বিশেষ করিয়া শুনিতেও অবসরপ্রাপ্ত হন নাই। একবিন্দু জলের জন্য কত বীর বিঘোরে কাফেরের হস্তে প্রাণ হারাইয়াছে। কত সতী পুত্রধনে, স্বামীরত্নে বঞ্চিত হইয়া নীরস কণ্ঠে আত্মবিসর্জন করিয়াছে, খঞ্জরের সহায়ে সে জ্বালা যন্ত্রণা নিবারণ করিয়াছে। কত বালকের কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া “জল জল” রব করিতে করিতে কণ্ঠরোধ এবং বাক্রোধ হইয়াছে, আভাসে, ইঙ্গিতে জলের কথা মনের সহিত প্রকাশ করিয়া, জগৎ কান্দাইয়া জগৎ ছাড়িয়া গিয়াছে। ভ্রাতৃগণ! আর কত শুনিবে? আমাদের প্রতি লোমকূপে, প্রতি রক্তবিন্দুতে এজিদের অত্যাচার-কাহিনী জাগিতেছে। মদিনার সিংহাসনের দুর্দশা, রাজপরিবারের বন্দিদশা, তাঁহাদের প্রতি অত্যাচার, অবিচারের কথা শুনিয়া আমরা বুদ্ধিহারা হইয়াছি; আজরাইল (স্বর্গীয় দূতের নাম। যিনি জীবনের প্রাণ হরণ করিয়া লইয়া যান, তাঁহারই নাম আজরাইল।) সম্মুখে বক্ষ পাতিয়া দিয়াছি; মৃত্যুমুখে দণ্ডায়মান হইয়াছি।”