সেকেন্ড অফিসার বিস্মিত হয়ে বললেন, এখন কি মানে?
জিডি এন্ট্রিতো করানো হল— এখন আপনারা কি করবেন?
আমরা একশান নেব।
কি একশান নেবেন?
কি একশান নেব সেটাতো আমাদের ব্যাপার। আপনার কিছু না।
ফিরোজ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল— আমি আসলে জানতে চাচ্ছি।–নিখোঁজ মানুষের বিষয়ে আপনারা কি করেন।
সব থানায় ইনফর্ম করা হয়।
তারপর?
তারপর মানে?
সব থানায় আপনারা জানালেন-তারপর থানাগুলি থেকে কি করা হয়।
সেকেন্ড অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন, সত্যি কথা জানতে চান? কিছুই করা হয় না।
কিছুই করা হয় না?
কি করা হবে? আপনার কি ধারণা থানার স্টাফ হারিকেন জ্বলিয়ে আপনার ভাইকে খুঁজতে বের হবে? খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি দেখেই এরা কুল পায় না মানুষ খুঁজে বেড়াবে কখন?
রেকর্ডের জন্যে দেই! একটা রেকর্ড থাকল। থানার রেকর্ডের গুরুত্ব অনেক বেশী। এই রেকর্ড থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বের হয়ে আসে। এমনওতো হতে পারে যে আপনি আপনার ভাইকে খুন করে ডেডবডি গুম করে থানায় এসে জিডি এন্ট্রি করালেন ভাই মিসিং। হতে পারে না?
জ্বি না, হতে পারে না।
আপনার কাছে হতে পারে না, কিন্তু অনেকের কাছে হতে পারে। আমার চাকরি বেশীদিন হয় নি—এর মধ্যেই এ ধরনের কেইস গোটা দশেক দেখেছি।
বলেন কি?
খুব বেশী দুঃশ্চিন্তা করবেন না। অল্প বয়েসী মেয়ে-টেয়ে হারিয়ে গেলে টেনশানের ব্যাপার থাকে। মেয়েরা ব্রেথেলে চলে যায়। বিদেশে চলে যায়। যৌনকামী হিসেবে বিদেশে বাংলাদেশী মেয়েদের সুনাম আছে।
কি বলছেন এসব?
শুনতে খারাপ লাগছে? সত্যি কথা শুনতে সব সময় চিরতার পানির মত লাগে। চিরতার পানি খেয়েছেন? না খেলে খাবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খেতেন। শরীরের জন্যে ভাল। শরীরটা ভাল রাখুন—Health is Wealth.
তাহলে আমি কি ধরে নেব— আপনারা আমার নিখোজ ভাই সম্পর্কে কিছু করবেন না?
কিছুই ধরে নেবেন না। একটা ভাল উপদেশ দেই শুনুন— ভাইয়ের ছবি দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে থাকুন। চালু পত্রিকাগুলিতে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দিন। খবৰ্দার, কোন পুরস্কার ঘোষণা করবেন না। পুরস্কার ঘোষণা করেছেন কি মরেছেন। জীবন অতিষ্ট হয়ে যাবে। ভাল একটা উপদেশ ফি ছাড়া আপনাকে দিলাম।
গত কয়েক মাসে ফিরোজের অন্যতম ও প্রধান কাজ হয়েছে উপদেশ শোনা। এবং প্রতিটি উপদেশ মানার চেষ্টা করা। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। শুরুতে প্রতিদিন। তারপর সপ্তাহে একদিন। তারপর একটি পত্রিকায় প্রতি পনেরো দিনে একবার। শুধু দেশী পত্রিকায় না—একজনের উপদেশ শুনে কোলকাতার আনন্দবাজার এবং স্টেটসম্যানেও বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
আরেকজনের উপদেশ শুনে জাতিসংঘের মিসিং পারসন বুরোতে কুড়ি ডলার খরচ করে নাম এন্ট্রি করিয়েছে। এরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চল এবং শরণার্থী মিসিং পারসনের তালিকা তৈরী করে।
একজন ফিরোজকে বলল ( ফিসফিসানি গলায় ) পাসপোর্ট অফিসে খোজ নাও তোমার ভাই রিসেন্টলি কোন পাসপোর্ট করিয়েছে কি-না। মানুষের ভেতরে অনেক জটিলতা থাকে— চট করে বোঝা যায় না। আমি একজনকে জানি ফ্যামিলী ম্যান। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যার জন্যে অসীম মমতা। হঠাৎ সে মিসিং পারসন হয়ে গেল। পাসপোর্ট অফিসে খোজ নিয়ে জানা গেল সে পাসপোর্ট করিয়েছে। সেই পাসপোটের সূত্র ধরে জানা গেল সে চলে গেছে অস্ট্রেলীয়ায়। খুব পাকাপাকিভাবে গিয়েছে ইমিগ্রেশন নিয়ে। অন্য একটা মেয়েকে বউ হিসেবে নিয়ে গেছে। কাজেই আমার মতে পাসপোর্ট অফিসে খোজ নেয়া খুবই জরুরী। অফিসিয়েলী এইসব কাজে অনেক সময় লাগে। দালাল ধরলে এক সপ্তাহের মধ্যে জানতে পারবে। হাজার খানিক টাকা খরচ হবে।
হাজার খানিক না— ফি রোজের তিন হাজার টাকা খরচ হল। তিন হাজার টাকার বিনিময়ে জানা গেল— হাসানুজ্জামানের নামে কোন পাসপোর্ট ইসু হয়নি।
একজন গম্ভীর মুখে বলল— মেডিক্যাল কলেজগুলির ছাত্ৰ-ছাত্রীদের জন্যে ডেড বডি কেনা হয় আপনি জানেন? সাধারণত কেনা হয় বেওয়ারিশ লাশ। বেওয়ারিস লাসের একটা ভাল মার্কেট বাংলাদেশে আছে। ঐসব জায়গায় খোজ নিয়েছেন? খোজটা নিতে হবে গোপনে। ডোমদের মাধ্যমে। এইসব বিজনেসে অনেক হ্রস হাস ব্যাপার আছে।
তুস হাস ব্যাপার মানে?
ফিসি ব্যাপার। আমার এক দূর সম্পর্কের রিলেটিভ, সম্পর্কের চাচা-তাঁর বড় ছেলে হঠাৎ হারিয়ে গেল। ওদের টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল না। বিরাট ক্ষমতাবান। এরা প্ৰায় তোলপাড় করে ফেলল। যাকে বলে কম্বিং অপারেশন। শেষে ছেলেটার ডেড বডি কোথায় পাওয়া গেল জানেন?
কোথায়?
মেডিক্যাল কলেজের ডিসেকসান রুমে। ছাত্ৰ-ছাত্রীরা ডেডবডি কাটাকুটি করছে— লিভার এক জায়গায়, কিডনী আরেক জায়গায়। হার্ট আরেক গামলায়। কাজেই খোঁজ খবর যখন করছেন ভালমত করেন— Leave no stone unturned.
ফিরোজ এখন ক্লান্ত এবং বিরক্ত। বিরক্তিটা কার উপর সে জানে না। সম্ভবত তার ভাইয়ের উপর। মানুষটা হারিয়ে গিয়ে সবচে বড় বিপদে তাকে ফেলে দিয়ে গেছে। দুপুর দুটায় ক্ষিধে পেটে পৃথিবীর সবচে বোরিং মানুষটার সামনে তাকে হাসিমুখে বসে থেকে— পরকাল, ইএসপি, ক্লেরিওভান্স, এসট্রেল, প্রজেকসন সম্পর্কে গল্প শুনতে হচ্ছে। কোন মানে হয়? কোন মানে হয় না। ফিরোজের এখন ইচ্ছা করে নিজেরই নিরুদেশ হয়ে যেতে। এক সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খাবে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। তারপর ভাল একটা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে হাসি মুখে ঘর থেকে বের হওয়া এবং আর ফিরে না আসা।