কুদ্দুসের মুখ হা হয়ে গেল। সে তাকাল ঘরের খোলা দরজার দিকে। শোভন আরেকটু এগিয়ে গেল। কুদ্দুস কিছু বলছে না। তার মুখ দিয়ে পানের রস গড়িয়ে পড়ছে। সে মুখ বন্ধ করতে ভুলে গেছে।
ইমন পর পর দুবার গুলির শব্দ শুনল। সে দেখছে কুদ্দুস নামের মানুষটা দরজার কাছে কুতুলি পাকিয়ে পরে গেছে। খোলা দরজায় লাল ফ্রক পরা বাচ্চা একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। টিনের বাড়িটার বারান্দা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়েটা চিৎকার করছে। কুদ্দুস হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে যাবার চেষ্টা করছে। কে যেন খুব শক্ত করে ইমনের হাত ধরেছে। ইমনকে টেনে গেট থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। কে? কে তাকে টেনে গেট থেকে বের করছে? ছোট চাচা? ছোট চাচা এখানে আসবেন কি ভাবে? শোভন ভাইয়া কোথায়? শোভন ভাইয়া?
ইমন হাঁটতে পারছে না। রাস্তা খুব উঁচু নিচু মনে হচ্ছে। বমি আসছে। ইমন বমি করতে শুরু করল। কে যেন তাকে টেনে বেবীটেক্সিতে তুলছে। কে ছোট চাচা? ছোট চাচা তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে থোক। আমি মরে যাচ্ছি। পুকুরে সাঁতার কাটার সময় তুমি আমাকে যেমন শক্ত করে ধরে রেখেছিলে ঠিক সেই ভাবে ধরে থোক। এত ঠান্ডা লাগছে কেন?
এই ইমন, ইমন!
ইমন তাকাল। তাকে ধরে শোভন বসে আছে। কিন্তু সে শোভনকে চিনতে পারল না। ইমন ভীত গলায় বলল, কে?
তোকে বাসায় রেখে আসি। এরকম করছিস কেন? পানি খাবি?
হ্যাঁ পানি খাব।
বেবীটেক্সিওয়ালা বলল, উনার কি হয়েছে?
শোভন বলল, জানি না।
মাথায় পানি ঢালেন।
শোভন বেবীটেক্সি থামিয়ে ইমনকে নিয়ে নামল। এক বেবীতে করে যাওয়া যাবে না। বেবী বদলাতে হবে। ইমনকে পানি খাওয়ানো দরকার। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে ইমন তাকে চিনতে পারছে না।
ইমন! ইমন!
জ্বি।
বেশি খারাপ লাগছে?
না।
চল বাসায় যাই।
বাসায় যাব না। আপনি দয়া করে আমাকে ছোট চাচার কাছে নিয়ে যান।
দরজা খুলে দিলেন সুরাইয়া। ইমন দরজা ধরে একা দাঁড়িয়ে আছে। সুরাইয়া আতংকিত গলায় বললেন, ইমন তোর কি হয়েছে? তুই এইভাবে তাকাচ্ছিস কেন?
ইমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মার দিকে। এবং মাকে চিনতে পারল না। ইমন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
সুরাইয়া ইমনকে ধরতে গেলেন। ধরার আগেই সে মেঝেতে পড়ে গেল। সে হামাগুড়ি দিয়ে এগুবার চেষ্টা করছে।
সুরাইয়া তীক্ষ্ণ ও তীব্র গলায় বললেন, কি হয়েছে? আমার ইমনের কি হয়েছে?
মানুষের জীবন চক্র
মানুষের জীবন কি চক্রের মত? চক্রের কোন শুরু নেই, শেষ নেই। মানব জীবনও কি তাই। রহস্যময় চক্রের ভেতর এই জীবন ঘুরপাক খেতে থাকে? শুরু নেই, শেষ নেই। চক্র ঘুরছে।
বিচিত্র চক্রের কথা ভাবতে ভাবতে সুরাইয়ার চোখে পানি এসে গেল। তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। আজ কি তাঁর জীবনের আনন্দময় একটি দিন? তিনি চোখের সামনে জীবনের রহস্যময় চক্ৰ দেখতে পাচ্ছেন? এই ব্যাপারটা এত দিন তার চোখে পড়ে নি কেন?
তিনি বারান্দায় বসে আছেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছেন। অনেকদিন আগে তাঁর শাশুড়ি আকলিমা বেগম ঠিক এই ভাবেই বসতেন। এবং এই জায়গাতেই বসতেন। তিনিও কি রহস্যময় জীবন চক্রের কথা ভাবতেন? তিনিও কি তার মত কাঁদতেন? কাঁদতে কাঁদতে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতেন?
সুরাইয়ার জীবনের একটা অংশ আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে—তিনি যেখানে শেষ করছেন মিতু সেখান থেকে শুরু করছে। মিতু আজ তার ছেলের বউ। এমন একটা আশ্চর্য মেয়ে তার এত কাছে ছিল আর তিনি লক্ষ্য করেন নি? তিনি এত বোকা কেন? এই মেয়েটা তার ছেলেকে রক্ষা করবে। কোন অমঙ্গল আর কোনদিন ইমনকে স্পর্শ করতে পারবে না।
তাঁর শোবার ঘরে মিতু এবং ইমনের বাসর হচ্ছে। একদিন এই খাটে তিনি এবং ইমনের বাবা ঘুমুতে এসেছিলেন। সুরাইয়া ভয়ে ছিলেন অস্থির। প্রায় অচেনা একটা ছেলে। তিনি চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতে পারছিলেন না। ইমনের বাবা বললেন, সুরাইয়া তুমি কি কোন কারণে ভয় পা।চ্ছ? তিনি চমকে উঠে বললেন, নাতো! এবং লক্ষ্য করলেন তাঁর সমস্ত ভয় কেটে গেছে। মিতু যে ভালবাসা দিয়ে আজ তাঁর ছেলের চারদিকে দেয়াল তুলেছে। একদিন তিনিও তাঁর স্বামীর চারদিকে দেয়াল তুলেছিলেন। তাঁর দেয়াল হয়ত তেমন কঠিন ছিল না। দেয়ালের কোন দুর্বল অংশ দিয়ে অমঙ্গল এসে ঢুকেছিল। ইমনের ক্ষেত্রে তা হবে না। মিতুর কঠিন দেয়াল ভেঙ্গে কোন অমঙ্গল আসতে পারবে না। তিনি যা পারেন নি—এই মেয়ে তা পারবে। এই মেয়ে তার মত না, এই মেয়ে কঠিন মেয়ে।
সুরাইয়া আবারো চোখ মুছলেন। সারা জীবন তিনি অপেক্ষা করেছেন। ইমনের বাবার জন্যে অপেক্ষা। মনে প্ৰাণে বিশ্বাস করেছেন মানুষটা ফিরে আসবে। ইমনের বিয়ের রাতে ফিরে আসবে। আজ সেই রহস্যময় রাত। কিন্তু আজ কেন জানি মনে হচ্ছে মানুষটা আসবে না। এলে ভাল হত। অনেক গল্প করা যেত।
এই তুমিতো ছিলে না, ইমনের উপর দিয়ে কি যে বিপদ গেল। ওর কি যেন হয়েছিল—কাউকে চিনতে পারে না। কাউকে না। শুধু যখন মিতু এসে বলল, তুই এরকম করছিস কেন? বলতো, আমি কে? ইমন তখন শুধু বলল, মিতু।
মিতুর সঙ্গে ইমনের বিয়ে দিয়েছি। আর আমি আজ সকালে মিতুকে বলে দিয়েছি—শোন বউমা, তুমি ইমনকে তুই তুই করবে না। শুনতে খুব বিশ্ৰী লাগে। মিতু হেসে বলেছে। আচ্ছা। কিন্তু আমার কি ধারণা জানো? আমার ধারণা—আমার আড়ালে ওরা একজন আরেকজনকে তুই তুই করেই বলবে। আচ্ছা বলুক। আমি তো আর শুনছি না।