জামিলুর রহমান স্ত্রীর দিকে না তাকিয়েই বললেন, বল।
ভেতরে চল।
যা বলার এখানেই বল। ভেতরে যেতে পারব না। চেয়ারে বস, তারপর বল।
তুমি ভেতরে যাবে না?
না।
ফাতেমা চেয়ারে বসলেন। তার মুখ থমথম করছে। তিনি কয়েক দিন থেকেই বড় রকমের ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঝগড়া শুরু করার সময়টা বের করতে পারছিলেন না। আজ মনে হচ্ছে সময় হয়েছে। ফাতেমা বললেন, তুমি আলাদা শোবার ব্যবস্থা করছি কেন?
উপরের ঘরটা বড়, খোলামেলা। আলো বাতাস আসে এই জন্যে।
আসল কথাটা বলছি না কেন?
আসল কথাটা কি?
আমাকে তোমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমার সঙ্গে ঘুমুতে তোমার এখন ঘেন্না লাগে।
ঘেন্না লাগবে কেন?
কেন ঘেন্না লাগছে সেটা আমি জানব কি ভাবে। সেটা তোমার জানার কথা।
তোমার ধারণা ভুল। ঘেন্নার কোন ব্যাপার না। একটা বয়সের পর মানুষ খানিকটা একা থাকতে চায়…
একা থাকতে চাইলে ঘরে পড়ে আছ কেন? বনে জঙ্গলে চলে যাও।
জামিলুর রহমান আরেক চুমুক ডাবের পানি খেয়ে স্ত্রীর উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। ভাব এ রকম যে কথাবার্তা যা হবার হয়ে গেছে।
ফাতেমা বললেন, তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার কথার জবাব দাও।
প্রশ্ন কর জবাব দিচ্ছি। প্রশ্ন না করলে জবাব দেব কিভাবে?
ফাতেমা হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। অনেক প্রশ্ন তাঁর করার ছিল, কান্নার জন্যে কোনটিই করতে পারলেন না। জমিলুর রহমান ডাবের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। স্ত্রীর কান্নায় তাকে মোটেই বিচলিত মনে হচ্ছে না। ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোমার টাকার অভাব নেই, তোমার অনেক টাকা। তুমি কিছু না বললেও আমি জানি। তুমি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
জামিলুর রহমান বললেন, রাখব। টাকা খরচ করে যদি অনুরোধ রাখা যায় তাহলে রাখব। অনুরোধটা কি?
আমাকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দাও। ছেলে মেয়ে নিয়ে আমি ফ্ল্যাটে থাকব।
আচ্ছা কিনে দেব। পছন্দসই ফ্ল্যাটের খোঁজ এনে দাও আমি কিনে দেব।
মিতুর বিয়ের গয়না কিনব—সেই টাকা দাও। আমি গয়না দিয়ে আমার মেয়েকে মুড়িয়ে দেব।
কত টাকা লাগবে বল। আমি ব্যবস্থা করছি। ফরহাদকে বলে দিচ্ছি।
ফরহাদটা কে?
অফিসের নতুন ম্যানেজার।
ফাতেমার কান্না থেমে গেছে। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তার সব কথা মেনে নেয়া হয়েছে। ফাতেমার মনে হচ্ছে তিনি এখন যাই বলবেন তাই মানুষটা মেনে নেবে। কিন্তু তার পরেও নিজেকে পরাজিত মনে হবে। যুদ্ধে জয়ী হয়েও পরাজিত হওয়ার এই অভিজ্ঞতা তার ছিল না। ফাতেমা এখন কি বলবেন? মাথায় কিছুই আসছে না। তিনি ইতস্ততঃ গলায় বললেন, তোমার শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে?
না, বেশি খারাপ লাগছে না। সামান্য খারাপ।
চল সিঙ্গাপুরে যাই ডাক্তার দেখিয়ে আসি। সিঙ্গাপুরে ভাল ভাল ডাক্তার আছে। দেশের বাইরে তো কোনদিন গেলাম না। এই সুযোগে বিদেশ দেখা হবে।
সিঙ্গাপুর বিদেশ না। সব সময় লোকজন যাচ্ছে। ভিসা লাগে না।
তুমি যেতে চাও আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি যাব না।
কেন তুমি যাবে না? আমার সঙ্গে যেতে কি তোমার ঘেন্না লাগে? আমি কি নর্দমার কেচো? না-কি কমোডের ভিতরে যে শাদা রঙের তেলাপোকা থাকে, সে রকম তেলাপোকা? তুমি আমাকে কি ভােব আজকে বলতে হবে। বলতেই হবে।
ফাতেমা আবারো কাঁদতে শুরু করলেন। জামিলুর রহমান স্ত্রীর কান্নার শব্দ পাচ্ছেন, কিন্তু সেই শব্দ তার মাথার ভেতরে ঢুকছে না। কান্নার অর্থ আছে, কান্নার পেছনে কারণ আছে, কান্নার ব্যাখ্যা আছে। অথচ ফাতেমার কান্নাটাকে তার কাছে অর্থহীন ধ্বনীর মত লাগছে—তিনি ভাবছেন সম্পূর্ণ অন্য কথা-গাজীপুর জঙ্গলের দিকে চল্লিশ বিঘা জমি কিনবেন। এক দাগের জমি। হিন্দুদের জমি না। তাদের জমিতে অনেক ভেজাল থাকে। একই জমি তিন চারজনের কাছে বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে যায়। মুসলমানের জমি, এবং কাগজপত্র ঠিক আছে এমন জমি দরকার। জমির দাম বাড়ছে। পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে, জমি বাড়ছে না। জমি কিনে এক বছর ফেলে রাখলেই হবে। খামার বাড়ির মত করা যেতে পারে। হাঁস মুরগি পালবেন, গরু ছাগল পালবেন। গাছ লাগানো হবে। আজ গাজীপুর থেকে লোক আসার কথা। জমির বায়না নিয়ে কথা হবে। অফিস থেকে টেলিফোন এলেই তিনি চলে যাবেন। তবে শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে। বারান্দা থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে
না।
ফাতেমা কেঁদেই যাচ্ছেন। জামিলুর রহমান সেই কান্নার ভেতরই টেলিফোনের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করছেন। চল্লিশ বিঘা জমি— অনেকখানি জমি। এক মাথায় দাড়ালে আরেক মাথা দেখা যাবার কথা না… ।
অফিস থেকে টেলিফোন এসেছে। অফিসের নতুন ম্যানেজার ফরহাদ টেলিফোন করেছে। টেলিফোন ধরেছে মিতু।
কে কথা বলছেন? বড় আপা?
জ্বি আমি মিতু। আমাকে বড় আপা কেন বলছেন? বাসায় তো আর কোন আপা নেই।
স্যার কি বাসায় আছেন আপা?
হ্যাঁ আছেন। আপনি ধরে থাকুন বাবাকে দিচ্ছি।
না স্যারকে দেয়ার দরকার নেই। আমি আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি। আপনি স্যারকে দিয়ে দেন।
ম্যানেজারের গলায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কথাও যেন ঠিকমত বলতে পারছে না। জড়িয়ে যাচ্ছে। মিতু বলল, ভায়া মিডিয়াম কথা বলবেন কেন? বাবা আছেন, বারান্দায় বসে আছেন। আমি ডেকে দিচ্ছি।
আপা শুনুন, আমার ভয় লাগছে। আমি স্যারকে কিছু বলতে পারব না। আপনি বলে দিন—অফিসে কিছুক্ষণ আগে শোভন সাহেব এসেছিলেন। স্যারের বড় ছেলে শোভন।