মানুষটার ফিরে আসার সময় যে হয়ে এসেছে তা সুরাইয়া বুঝতে পারছেন। কষ্টের পর সুখ আসে, অনেকগুলি কষ্ট তিনি পার করেছেন–এখন সুখ আসার সময়। আগের বাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে বসার পরই সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটবে। দরজার কড়া নড়বে। না, কড়া না-কলিং বেল বাজবে। একবার দুবার তিনবার। থেমে থেমে বেজেই যাবে। তিনি ভাববেন, ভিখিরী। ক্লান্তিহীন কলিং বেল একমাত্র ভিখিরীরাই বাজায়। তিনি নিতান্ত বিরক্ত হয়ে দরজা খুলবেন। ভিখিরী না, মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই মানুষটা কোমল গলায় বলবেন—ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
তিনি বলবেন, না।
মানুষটা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলবে, ইমন কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
না জেগে আছে। তুমি এসেছ ভাল হয়েছে, ইমনকে শাসন করতে হবে। ও কি রকম যেন হয়ে গেছে। পরীক্ষা দিচ্ছে না। দিন রাত দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। সিগারেটও ধরেছে। প্রায়ই তার ঘরে সিগারেটের গন্ধ পাই।
বল কি? আমি খুব চিন্তার ভেতর ছিলাম। তুমি এসেছি, এখন আর চিন্তা করছি না। সারাজীবন অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। এখন যা চিন্তা করার তুমি করবে। আমি রেস্ট নেব। খাব, দাব, ঘুমাব। সিনেমা দেখব। কতদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয় না। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।
তিনি চিন্তিত গলায় বলবেন, এখন সে কি আর আমার কথা শুনবে? একটা বয়সের পর ছেলেরা বাবা-মা কারো কথাই শুনতে চায় না। শুধু স্ত্রীর কথা শুনে। ওকে বিয়ে দিতে হবে।
সুরাইয়া আনন্দিত গলায় বলবেন, কি যে মজার কথা তুমি বল। ইমনের বিয়ে দিয়েছিতো।
সে কি! কবে বিয়ে হল?
আজই হয়েছে। আজ বাসর হচ্ছে, আমাদের শোবার ঘরটা ওদের ছেড়ে দিয়েছি।
মানুষটা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলবে, ভাল করেছ। বউমাকে ডাক একটু দেখি।
সর্বনাশ! এখন ওদের ডাকতে পারব না। সকালে দেখবে। তুমি বরং তোমার এই বেতের চেয়ারটায় বোস। চা খাবে?
বেতের চেয়ারটা এখনো আছে? আশ্চর্য! কত দিনের কথা। আচ্ছা! সুরাইয়া তুমিতো আমাকে দেখে এতটুকুও অবাক হও নি। তুমি কি জানতে আজ আমি আসব?
হুঁ জানতাম। বালতির পাশে স্পঞ্জের স্যান্ডেল আছে। পা ধুয়ে বসোতো, আমি চা নিয়ে আসছি।
দরজা খুলে ইমন বের হয়ে এল। সে বাইরে কোথাও যাচ্ছে-সার্ট প্যান্ট পরেছে। সুরাইয়া বললেন, কোথায় যাচ্ছিস? ইমন বলল, কোথাও না।
সুরাইয়া সহজ গলায় বললেন, ইমান শোন–পরীক্ষা দিচ্ছিস না, এই নিয়ে মন খারাপ করবি না। সামনের বছর দিলেই হবে।
আমি মন খারাপ করছি না।
তোর কি ফিরতে দেরি হবে? ফিরতে দেরি হলে চাবি নিয়ে যা। আমি মুন্নীকে নিয়ে বের হচ্ছি। কখন ফিরব ঠিক নেই।
আচ্ছা।
আমি কিছু কেনা কাটা করব। আগে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম ঐ বাড়িটা পাওয়া গেছে। বুঝলি ইমন, বাড়িটা আমি ঠিক আগের মত করে সাজাব। তোর বাবা এসে যেন দেখতে পান কিছু বদলায় নি। সব আগের মত আছে। তুই তোর বড় মামার বাসা থেকে খাটটা এনে দিবি।
এখনি এনে দিতে হবে?
এখন না আনলেও হবে। নতুন বাসায় যেদিন যাব সেদিন এনে দিলেও হবে।
যখন বলবে। এনে দেব।
তুই যাচ্ছিস কোথায়?
বললাম তো কোথাও না।
ইমন হন হন করে বের হয়ে গেল। চাবি না নিয়েই গেল। সুরাইয়া চাবি সঙ্গে নেবার ব্যাপারটা আবারো মনে করিয়ে দেবার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার, যতই দিন যাচ্ছে তিনি ছেলেকে ততই ভয় পেতে শুরু করেছেন।
বাসার গেটের কাছে মুন্নী দাঁড়িয়ে আছে। ইমনকে দেখে সে হঠাৎ বলল, ইমন ভাইয়া, ভাল আছেন?
ইমন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মুন্নীর মনে হল এক্ষুনি সে তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাবে এবং প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বের হয়ে যাবে। মুন্নীকে অবাক করে দিয়ে ইমন বলল, আমি ভাল আছি।
মুন্নী বলল, আপনাকে আমি প্রায়ই দেখি কলাবাগান বাস স্ট্যান্ডের শিশু পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছেন। ওখানে যাবেন না।
কেন?
ঐ পার্কে একটা পাগল থাকে। ছুরি নিয়ে মানুষকে তাড়া করে। দুজনকে জখম করেছে। পত্রিকায়ও উঠেছে।
আমি জানি। পাগলটার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।
আপনার ভয় লাগে না?
না।
আপনাকে আটকে রাখলাম, কিছু মনে করবেন না।
আমি কিছু মনে করি নি।
ইমন শিশুপার্কের দিকে হাঁটা শুরু করল। পার্কের বেঞ্চবীতে কোন কারণ ছাড়া চুপচাপ বসে থাকতে তার ভালই লাগে। ঘণ্টাখানিক চুপচাপ বসে থাকার পর তার নিজেকে গাছের মত মনে হতে থাকে। যেন সে এক সময় মানুষ ছিল, এখন গাছ হয়ে যাচ্ছে। তার শিকর চলে যাচ্ছে মাটির গভীরে। শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে। যখন বৃষ্টি আসবে সে বৃষ্টির পানিতে স্নান করবে। যখন জোছনা নামবে সে তার সারা গায়ে জোছনা মাখবে। আহ। বৃক্ষের জীবনতো আসলেই আনন্দময়।
ফাঁসি, যাবজীবন, সশ্রম কারাদন্ড
ফাঁসি, যাবজীবন, সশ্রম কারাদন্ড কিছুই হল না। শোভনকে জাজ সাহেব বেকসুর খালাস করে দিলেন। চারজন সাক্ষীর মধ্যে দুজন আসেই নি। বাকি দুজন উল্টা পাল্টা কথা বলে সব এলোমেলো করে দিয়েছে। পুলিশের মামলা সাজানোও দেখা গেল অত্যন্ত দুর্বল। যথাসময়ে আলামতও হাজির হল না। জাজ সাহেব বিরক্ত মুখে রায় লিখলেন, তারচেয়েও বিরক্ত মুখে পড়লেন।
শোভনও জাজ সাহেবের মতই বিরক্ত মুখে বের হয়ে এল। ইমন তাকে নিতে এসেছে। আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শোভন হাই তুলতে তুলতে বলল, আর কেউ আসে নি?
ইমন বলল, না।
আজ যে রায় হবে ওরা জানে?
জানে।
ফুলের মালা এনেছিস?
ইমন কিছু বলল না। শোভন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ফুলের মালা গলায় দিয়ে বের হতে পারলে ভাল হত। নেতা নেতা ভাব চলে আসতো। তোর কাছে টাকা আছে?