বিয়ে নামক ইন্সটিটিউশনটা নিয়ে ভাবা যাক। বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে কুৎসিত লাগছে। সম্পূর্ণ অচেনা একটি মেয়ে এবং একটা ছেলে। দুজনকে দুপ্রান্ত থেকে এনে বলা হল এখন থেকে তোমরা এক সঙ্গে থাকবে। তারা দু জন প্রথমবারের মত একসঙ্গে ঘুমুতে গেল। প্রশস্ত খাট, ফুল তোলা চাদরে কিছু ফুল। খাটটা সাজানো হয়েছে জরির মালায়। ছেলেটা মেয়েটার গায়ে হাত রাখবে। মেয়েটা লজ্জা এবং ভয়ে চুপ করে থাকবে। আতংক নিয়ে অপেক্ষা করবে–তারপর কি হয়।
আফা ও আফা।
মজিদের মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। পান খাওয়া লাল দাঁত সবকটা বের হয়ে আছে।
ও আফা টেলিফোন।
কার টেলিফোন?
নতুন দুলাভাই। হিহিহি।
হি হি করতে হবে না। নিচে যাও, আমি আসছি।
মিতু টেলিফোন হাতে নিয়ে খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল আপনি কেমন আছেন?
জুবায়ের একটু ইতস্ততঃ ভঙ্গিতে বলল, ভাল। তুমি কেমন আছ? তুমি করে বললাম। আশা করি কিছু মনে করছ না?
জি না মনে করছি না।
টেলিফোন পেয়ে বিরক্ত হচ্ছি নাতো?
বিরক্ত হচ্ছি না।
আমি আবার খুব ভয়ে ভয়ে টেলিফোন করলাম।
ভয়ে ভয়ে কেন?
তুমি আবার কি মনে কর।
আমি কিছু মনে করছি না।
তোমার পরীক্ষাতো এখন চলছে—তাই না?
জ্বি।
মাঝে গ্যাপ আছে না?
আছে। কাল পরশু এই দুদিন পরীক্ষা নেই। আপনি কি আমাকে বাইরে লাঞ্চের দাওয়াত করতে চাচ্ছেন?
আশ্চর্য! তুমি বুঝলে কি করে?
আমার ই এস পি ক্ষমতা আছে। আমি মানুষের মনের কথা প্রায়ই ধরতে পারি।
তোমাকে বিয়ে করাতো তাহলে খুবই বিপদজনক!
কিছুটা বিপদজনকতো বটেই।
তুমি এমন ভাবে কথা বলছি যেন সত্যি সত্যি তোমার ই এস পি ক্ষমতা আছে।
আসলেই আছে। প্রমাণ দেব? আপনি এই মুহুর্তে সাদা একটা প্যান্ট পরে আছেন। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা যেমন সাদা প্যান্ট পরে সে রকম সাদা প্যান্ট। হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। মাই গড—তুমিতো সত্যি সত্যি আমাকে ঘাবড়ে দিচ্ছি। মিতু শোন, আজতো তোমার পরীক্ষা নেই?
জি না নেই।
আজকে আমার সঙ্গে বাইরে খেতে চল। খেতে খেতে তোমার ই এস পি পাওয়ার নিয়ে গল্প করব।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার পড়ার ক্ষতি হবে নাতো?
একটু হবে। কি আর করা। অবশ্যি আমার এখন পড়তেও ভাল লাগছে না।
তাহলে কাপড় পরে তৈরি হয়ে থোক। আমি এসে নিয়ে যাব।
জি আচ্ছা।
তোমার গলার স্বরটা এমন লাগছে কেন?
কি রকম লাগছে?
বিষাদময় লাগছে। ইংরেজীতে যাকে বলে Plaintive Voice. তোমার কি মন খারাপ?
জ্বি মন খারাপ। বেশ খারাপ।
কারণটা কি জানতে পারি? অবশ্যি বলতে যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে।
না। আমার কোন আপত্তি নেই। আপত্তি কেন থাকবে? আমার এক ফুপাতো ভাই আছে। সেও অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছিল। আজই খবর পেয়েছি একটা পরীক্ষা দিয়ে সে আর পরীক্ষা দিচ্ছে না। মনটা খুব খারাপ হয়েছে।
পরীক্ষা দিচ্ছে না কেন?
জানি না। অনেকদিন ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।
টেলিফোনে খোঁজ নেয়া যায় না?
ওদের টেলিফোন নেই।
তাহলে একটা কাজ করা যেতে পারে, দুপুরে লাঞ্চের পর ওদের বাসায় গিয়ে আমরা খোঁজ নিতে পারি। আমার সঙ্গে গাড়ি থাকবে, ট্রান্সপোর্ট কোন সমস্যা হবে না। আর তুমি যদি মনে কর তুমি একা যাবে-তাহলে গাড়িটা আজ সারাদিনের জন্যে তুমি রেখে দিতে পার।
না। তার দরকার নেই। আমি আসলে জানতেও চাচ্ছি না। যা হবার হবে।
তোমার ফুপাতো ভাই ছাত্র কেমন?
ও খুব ভাল ছাত্র। এস. এস. সি, এইচ. এস. সি. দুটাতেই ষ্ট্যান্ড করেছে।
ওর নামটা তুমি কি বলেছিলে? আমি ভুলে গেছি।
নাম আপনাকে বলিনি, ওর নাম ইমন।
তাকে কি তুমি খুব পছন্দ করা?
হ্যাঁ করি। তবে ও রোবট টাইপের তো কারো পছন্দ অপছন্দের ধার ধারে না। পছন্দ করলেও ক্ষতি নেই। না করলেও ক্ষতি নেই।
বললে তো আপনি আবার রাগ করবেন।
না মোটেই রাগ করব না, তবে তুমি এই যে আপনি আপনি করে কথা বলছ এতে রাগ করছি। সামান্য হলেও রাগ করছি। তুমি কি দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবে?
আপনি বললে বলব।
আমি বলছি।
বালছ যখন তখন অবশ্যই তুমি করে বলব।
এখন বল আমি কোন টাইপের মানুষ?
তুমি গায়েপড়া ধরণের মানুষ। একদল পুরুষ আছে যারা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে খুব পছন্দ করে। তুমি সেই টাইপ।
ও।
রাগ করলে?
না রাগ করিনি।
মিতু হাসল।
জুবায়ের বলল, হাসছ কেন?
মিতু বলল, আমার কথা শুনে তুমি খুব হকচকিয়ে গেছে। এই জন্যে হাসি আসছে।
ও আচ্ছা।
আরেকটা মজার ব্যাপার কি জান? তোমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমার বিয়ে হবে না।
কেন?
কেন ঠিক জানি না। আমার সিক্সথ সেন্স তাই বলছে।
তোমার বিয়েটা কার সঙ্গে হবে? ঐ যে ইমন না-কি যেন নাম তার সঙ্গে?
বাহ তোমার সিক্সথ সেন্সও তো খুব ভাল।
মিতু খিলখিল করে হাসছে। সে শুনল ওপাশে টেলিফোন রিসিভার নামিয়ে রাখা হয়েছে। তারপরেও সে হাসছে। কেন জানি তার খুব মজা লাগছে। তার সিক্সথ সেন্স বলছে ভদ্রলোক তাকে নিয়ে লাঞ্চে যাবার উৎসাহ এখন আর পাচ্ছেন না। তিনি এখন মিতু নামক মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর শুরু করবেন। এবং শুক্রবারের পান চিনি উৎসব বাতিল হয়ে যাবে।
সুরাইয়াকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে
অনেকদিন পর সুরাইয়াকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। তিনি পান খেয়েছেন। পান খাবার কারণে ঠোঁট লাল হয়ে আছে। মুখ হাসি হাসি। চোখ জ্বল জুল করছে। চাপা আনন্দের কোন ঘটনা ঘটলেই মানুষের চোখ এরকম জুলে। সুরাইয়ার আনন্দের কারণ হচ্ছে পুরানো ভাড়া বাড়িটা পাওয়া গেছে। আগের বাড়িওয়ালা যথেষ্ট ভদ্রতা করেছেন। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছেন। ভাড়া বেশি, আগে যে ভাড়া ছিল তার দ্বিগুনেরও বেশি, তবু সুরাইয়ার কাছে মনে হচ্ছে তুলনামুলক ভাবে ভাড়া সস্তা। বড় টানা বারান্দার খোলামেলা বাড়ি আজকাল পাওয়াই যায় না। সবাই বড় বাড়িগুলিকেও খুপরি খুপরি বানিয়ে ফেলছে। শান্তিমত নিঃশ্বাস নিতে হলেও খানিকটা খোলা জায়গা দরকার—এই ব্যাপারটা শহরবন্দি মানুষ ভুলে যেতে বসেছে।