সেদিন কি হল শোন। কাকরাইলের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি তিনটা ছেলে (আমার মত বয়েসী) আধাবুড়ো এক রিকশাওয়ালাকে কিল চড় ঘুসি মারছে। রিকশাওয়ালা নাকি তাদের সঙ্গে কি বেয়াদবী করেছে। রিকশাওয়ালার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। অনেক লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে মারের দৃশ্য দেখছে। কেউ কিছু বলছে না।
এক পর্যায়ে রিকশাওয়ালার লুঙ্গি খুলে পড়ে গেল। লুঙ্গি টেনে শরীরে জড়ানোর মত শক্তিও তার নেই। নগ্ন একজন মানুষ মার খাচ্ছে-কুৎসিত দৃশ্য। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার প্যান্টের পকেটে লতা-ফুল-পাতা আঁকা পিস্তল। অথচ আমিও কিছু বলছি না। আমি কি খুব সহজেই বলতে পারতাম না—যথেষ্ট হয়েছে। এখন সব বন্ধ। তোমরা তিনজন কানে ধরে দশবার ওঠবোস কর এবং বুড়ো মানুষটার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আমি কিছুই করলাম না। মাথা নিচু করে চলে এসেছি।
সুপ্ৰভা শোন, মা যেমন রাতে ঘুমায় না, আমিও ঘুমাই না। মা জেগে থাকে তার ঘরে। আমি জেগে থাকি আমার ঘরে। মার জেগে থাকার তাও একটা অর্থ আছে। তিনি অপেক্ষা করেন। মার অপেক্ষা বাবার জন্যে। আমিতো কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করি না।
রাত জেগে আমি অনেক কিছু ভাবি। সেই অনেক ভাবনার একটা হল—মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে অপেক্ষা নামের ব্যাপারটির খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক। মার শরীরের যে অবস্থা তাতে তার বেঁচে থাকার কথা না, তারপরেও আমার ধারণা তিনি দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকবেন কারণ তিনি অপেক্ষা করছেন। বড় মামা বেশী দিন বাঁচবেন না, কারণ তিনি এখন আর কোন কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছেন না।
ইমন লেখা বন্ধ করল। ফজরের আজান হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক ফর্স হতে শুরু হবে। দিনের আলোয় এই চিঠি লেখা যাবে না। ইমনের হাই উঠছে, ঘুম পাচ্ছে। কিছুদিন হল ঠিক ফজরের আজানের পর পর তার ঘুম আসে। ইমন লেখা কাগজগুলি হাতে নিয়ে এখন কুচি কুচি করে ছিড়ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এখন তার চেষ্টা কত ছোট কাগজের কুচি করা যায় তা দেখা। কাগজের কুচিগুলিকে এখন দেখাচ্ছে জুই ফুলের মত। সারা ঘরময় ছড়িয়ে তার উপর দিয়ে হাঁটতে হবে—কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন।
শীতকালের সকাল
শীতকালের সকাল। মিতু মন খারাপ করে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আশৈশবের চেনা ছাদটাকে চেনা যাচ্ছে না। ছাদের চারদিকে রেলিং হয়েছে। রেলিং এর ধার ঘেসে ফুলের টব। জমিলুর রহমান সাহেবের হঠাৎ করে গাছের নেশা হয়েছে। তিনি রোজই ফুলের টব কিনে আনছেন। বস্তা ভর্তি মাটি আনছেন, সারা আনছেন। মহা উৎসাহে মাটি এবং সার মাখিয়ে মিকচার তৈরি হচ্ছে। সেই মিকচার টবে ভরা হচ্ছে। তাঁর একত্ৰিশটা টাব আছে শুধুই গোলাপের। ফুটন্ত গোলাপের সংখ্যা সাতচল্লিশ। জামিলুর রহমান রোজ সকালে এসে একবার করে গোলাপের সংখ্যা গুণেন। ব্যবসায়ী মানুষ বলেই হয়ত সাতচল্লিশকে মনে মনে পাঁচ দিয়ে গুণে ফেলেন। দুইশ পয়ত্রিশ। অর্থাৎ ছাদের বাগানের গোলাপের বর্তমান বাজার দর পাঁচ টাকা করে পিস ধরলে দুইশ পয়ত্ৰিশ টাকা। তাকে তখন অত্যন্ত আনন্দিত দেখায়। তিনি যে শুধু ফুটন্ত গোলাপের হিসাব রাখেন তাই না, কতগুলি কুড়ি আছে তারও হিসাব রাখেন। কুড়ির বর্তমান সংখ্যা বাষট্টি।
মিতুর এইসব ভাল লাগে না। ছাদটা নষ্ট হয়ে গেল। এই ভেবে তার মন খারাপ হয়। আগের খোলামেলা মাঠ মাঠ ভাব নেই। চারদিকে রেলিং উঠায় ছাদের চরিত্র বদলে গেছে। এখন মনে হয় মিনি জেলখানা। মিতু এক সময় ছাদের শেষ প্রান্তে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত, সেটা আর হবে না। তাছাড়া ছাদে উঠলেই একা হয়ে যাবার যে ব্যাপার ছিল তা এখন ঘটছে না। জমিলুর রহমান সাহেবকে সকাল বিকাল দুবেলাই ছাদে পাওয়া যাচ্ছে। মিতুর আশংকা তার বাবার উৎসাহ যে ভাবে বাড়ছে তাতে কিছুদিন পর দেখা যাবে তিনি দিনরাত ছাদেই পড়ে আছেন। মানুষ অদ্ভুত প্ৰাণী, কখন কোন নেশা ধরে যায় বলা কঠিন।
শীতের এই সকালে জামিলুর রহমানকে একটা গেঞ্জি গায়ে দেখা যাচ্ছে। তার নাক-মুখ রুমাল দিয়ে বাধা। তিনি গোলাপের গাছে ইনসেকটিসাইড স্প্ৰে করছেন। গোলাপের গাছে কীট পতঙ্গের সংক্রমণ দ্রুত হয়। সুন্দরের প্রতি শুধু যে মানুষের আকর্ষণ তা না, কীট পতঙ্গেরও তীব্র আকর্ষণ।
মিতু বাবার দিকে এগিয়ে গেল। জমিলুর রহমান স্পে করা বন্ধ করে বললেন, কাছে আসিস না মা। দূরে থাক। তীব্ৰ বিষ।
মিতু দাঁড়িয়ে গেল। জামিলুর রহমান বললেন, মিতু তুই একটু নিচে যা, তোর মা ডাকছে। আমার জন্যে এক কাপ চা পাঠিয়ে দিস।
মিতুর নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না। কারণ আজ তাকে দেখতে লোক এসেছে। মিতু চায়ের ট্রে নিয়ে যাবে এবং কাপে করে সবাইকে চা তুলে তুলে দেবে। ছেলে নিজেও এসেছে। মিতুর রাগে শরীর জুলছে। ছেলেটার কি লজ্জা বলেও কিছু নেই। বাড়ি বাড়ি মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছে। এর আগেও নিশ্চয়ই সে অন্য সব মেয়েদের বাসায় গিয়েছে। মেয়ের হাতে বানানো চা খেয়েছে। গল্প গুজব করেছে। মিতুকে দেখার পরেও আরো অনেকের বাড়িতে যাবে। তারপর বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই মেয়েটা ফর্সা। তবে একটু খাটো। ঐ মেয়েটা লম্বা আছে। তবে শ্যামলা। মগবাজারের মেয়েটার সবই ভাল ছিল শুধু একটা দাঁত ভাঙ্গা। ঝিকাতলার মেয়েটার চুল। লালচে। লালচে চুলের মেয়ের স্বভাব চরিত্র ভাল হয় না।