সুপ্ৰভা, তুই কি জানিস শোভন ভাইয়া এবং টোকন ভাইয়া তোকে অসম্ভব ভালবাসে। তোর কথা উঠলেই তাদের চোখে পানি আসে। আশ্চর্য কাণ্ড, তোর দেখি তলে তলে সবার সঙ্গেই খাতির ছিল। সবাই তোকে এত পছন্দ করে কেন? রহস্যটা কি?
আমাকে কিন্তু কেউ তেমন পছন্দ করে না। এটা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। ছোটবেলায় কেউ আমাকে খেলতে নিত না। তুই শুনে খুব অবাক হবি স্কুলের সব ছেলেরা একবার কোন কারণ ছাড়াই আমাকে মাটিতে ফেলে মেরে প্রায় ভর্তা বানিয়ে ফেলেছিল। আমাদের জিওগ্রাফি স্যার শেষে ছুটে এসে আমাকে উদ্ধার করেন।
এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি—এখানেও একই সমস্যা। ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার সময় ভাইবা পরীক্ষা হয়। ভাইবায় আমাকে যে সব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার প্রতিটির উত্তর আমি দিয়েছি। তারপরেও নম্বর পেয়েছি মাত্ৰ ৫০, অথচ অন্যরা ৭০, ৭৫ পেয়েছে। ও তোকেতো বলা হয় নি ফাস্ট ইয়ার থেকে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠার পরীক্ষায় আমি খুব ভাল করেছি। থিওরী পরীক্ষার প্রতিটায় খুব ভাল করেছি। স্যাররা এখন মনে হয় ভাইবায় আমাকে কম নাম্বার দেয়ায় নিজেরাই লজ্জিত।
স্যারদের ধারণা আমি রেকর্ড নাম্বার নিয়ে পাশ করব। আমার সে রকম ধারণা না। আমার মনে হচ্ছে। আমি শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দেব না। আমার কিছুই ভাল লাগে না। প্রায়ই ইচ্ছা করে সব ছেড়ে ছুঁড়ে বাবার মত কোথাও চলে যাই।
এমন কোথাও যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। কেউ আমাকে চিনবে না, আমিও কাউকে চিনতে পারব না। আমার কথাবার্তা কি তোর কাছে এলোমেলো লাগছে?
আমার মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়েছে ঠিকই। প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি। দুঃস্বপ্নগুলির মধ্যেও কোন ভেরিয়েশন নেই–একই দুঃস্বপ্ন—খালি গায়ে শুয়ে আছি, হঠাৎ গায়ের উপর দিয়ে কুৎসিত একটা মাকড়সা হেঁটে যেতে শুরু করল। আমি বিকট চিৎকার দিয়ে মাকড়সাটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করেও ফেলতে পারলাম না। সে আঙ্গুল কামড়ে ঝুলে রইল। আমার কি ধারণা জানিস? আমার ধারণা আমি যদি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাই তাহলে আমার ভুবন হবে মাকড়সাময়। আমার চারদিকে কিলবিল করবে। অসংখ্য মাকড়সা। আমাকে যে খাবার দেয়া হবে সে খাবার খেতে গিয়ে দেখব—মাকড়সার ঝোল আলু এবং সীম দিয়ে রান্না করা হয়েছে। এসব কি লিখছি? আমার গা ঘিনঘিন করছে।
মার কথাতো তোকে বলা হয় নি-মা ভাল আছে। খুব ভাল না, মোটামুটি ভাল। মা এখন আমাকে কিছুটা ভয় পায়। এটা বিরাট একটা ঘটনা না? তার এখনো ধারণা যেদিন আমার বিয়ে হবে সেদিন বাবা ফিরে আসবেন। তার অপেক্ষার শেষ হবে।
তিনি আমার জন্যে মনে মনে একটা পাত্রীও ঠিক করে ফেলেছেন। মেয়েটার নাম মুন্নী। মার ধারণা এই পৃথিবীতে মুন্নীর মত ভাল মেয়ের জন্ম হয় নি। আমার ধারণা অবশ্যি সে রকম না। নানা রকম দুঃখ কষ্ট, বঞ্চনার ভেতর দিয়ে সে বড় হয়েছে বলে তার ভেতর বেশ কিছু ধাপ্লাবাজী ঢুকে গেছে। এই জাতীয় মেয়েদের প্রধান ঝোক থাকে মানুষকে পটানো। মাকে সে ইতিমধ্যে পটিয়ে ফেলেছে। খুব শিগগীরই সে আমাকে পটানোর একটা চেষ্টা চালাবে বলে আমার ধারণা।
আচ্ছা সুপ্ৰভা, তুই কি নবনীর কথা জানিস? মিতু কি তোকে নবনী সম্পর্কে কিছু বলেছে? মনে হয় বলেনি। মিতু আবার কাউকেই কিছু বলে না। সব কথা পেটে রেখে দেয়। নবনীকে আমি অংক শেখাই। আমাদের এক স্যার এই প্রাইভেট টিউশ্যানিটা আমাকে জোগাড় করে দিয়েছেন। হুলুস্থুল টাইপের বড়লোকের মেয়ে। চেহারা জাপানী পুতুলের মত, ভাবভঙ্গিও পুতুলের মত। একমাত্র মেয়ে হলে যা হয়। আহ্লাদ না করে কোন কথা বলতে পারে না। আমি যদি তাকে জিজ্ঞেস করি।-অংকটা বুঝতে পেরেছ? সে কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে হাসবে তারপর টেনে টেনে বলবে-জানি না। আমি যদি বলি-আবার বুঝিয়ে দেব? সে আগের মত টেনে টেনে বলবে, ইচ্ছে হলে বুঝাতে পারেন, ইচ্ছা না হলে নাই। ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত বিরক্তিকর।
নবনী টাইপ মেয়েরা করে কি জানিস? তারা পরিচিত অর্ধপরিচিত সব ছেলের সঙ্গেই প্ৰেম প্ৰেম ভাব নিয়ে কথা বলে। এ রকম করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। তখন এই কান্ডটা সবার সঙ্গেই করে। বর্তমানে আমার সঙ্গে করছে। জন্মদিনে উপহার কিনে দিচ্ছে। আমি খুবই বিব্রত বোধ করছি। মেয়েটা সম্ভবত তার বাবা-মাকেও আমার বিষয়ে কিছু বলেছে। কারণ কয়েকদিন আগে মেয়েটির বাবা আমার সঙ্গে অনেক কথা টথা বললেন। দেশের বাড়ি কোথায়? ক ভাইবোন? এইসব। শেষটায় বললেন, তারা সিলেট হয়ে শিলং বেড়াতে যাচ্ছেন। আমি যদি শিলং না দেখে থাকি তাহলে যেন তাদের সঙ্গে যাই। আমার অবস্থাটা কি বুঝতে পারছিস? আমি নবনীদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তবে খুব ভয়ে ভয়ে আছি কবে না জানি সে খুঁজে খুঁজে বাসায় উপস্থিত হয়!
আমার পড়াশোনার কথা তোকে চিঠির শুরুতে একভাবে লিখেছিলাম। এখন অন্যভাবে বলি, তোর মৃত্যুর পর থেকে আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। কেন জানি বই পড়তে ভাল লাগে না। ঘরে থাকতেও ভাল লাগে না। তিনটা ক্লাস এসাইনমেন্ট জমা দেই নি। নিয়মিত যে ক্লাসে যাচ্ছি তাও না। ঘরে যখন থাকি বিছানায় শুয়ে থাকি। বাইরে যখন থাকি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি। এর নাম হন্টন-সিনড্রোম।
রাস্তায় যখন হাঁটি তখন আমার গায়ে থাকে চাদর। এখন শীতকাল কাজেই চাদর থাকতেই পারে। চাদরের নিচে, প্যান্টের পকেটে ভয়াবহ একটা বস্তু থাকে। এই ভয়াবহ বস্তুটা আমাকে লুকিয়ে রাখতে দিয়েছেন শোভন ভাইয়া। আমি লুকিয়েই রাখি। হঠাৎ হঠাৎ পকেটে নিয়ে বের হই। তখন খুব অন্যরকম লাগে। পৃথিবীটাকে নিজের পায়ের নিচে মনে হয়। এমিতেই পৃথিবী আমাদের পায়ের নিচে, যদিও তা কখনো মনে হয় না। ঐ বস্তুটা পকেটে থাকলেই শুধু মনে হয়। এবং কি ইচ্ছা করে জানিস? ইচ্ছা করে আশে পাশের সব দুষ্টলোক মেরে ফেলি। এখন তুই কি বুঝতে পারছিস বস্তুটা কি? যা ভাবছিস তাই-পিস্তল। পিস্তলের নাম ধামতো জানি না—তবে পিস্তলের গায়ে রাশিয়ান ভাষায় কি সব লেখা দেখে মনে হচ্ছে রাশিয়ায় তৈরি। জিনিসটা ছোট্ট এবং সুন্দর। হাতের মুঠোর মধ্যে আটে। ধরার বাটটা রূপালী। মনে হয় রূপার তৈরি। বাটে সুন্দর সুন্দর ছবি, গাছ-লতা-পাতা-ফুল এইসব।