ইমন!
বল।
মুন্নী মেয়েটাকে তুই দেখেছিস না? মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে রাতে এসে থাকে।
হুঁ।
মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
ভাল।
শুধু ভাল না, মেয়েটা আসলে খুবই ভাল। তুইতো তার সঙ্গে কথা বলিসনি কাজেই তুই জানিস না। আমার সঙ্গে অনেক কথা হয় আমি জানি। মেয়েটা তোকে খুব পছন্দ করে।
পছন্দ করলে তো ভালই।
ভাল হত।
ভাল হত কেন?
ভাল একটা মেয়ে-এই জন্যেই ভাল হত।
মেয়েটাকে তোমার যত ভাল মনে হচ্ছে সে তত ভাল না। কাছুয়া টাইপ মেয়ে।
কাছুয়া টাইপ মেয়ে মানে?
মানে তুমি বুঝবে না মা। বাদ দাও।
আমি বুঝব না, আর তুই সব বুঝে বসে আছিস? এত তাড়াতাড়ি এত লায়েক কি ভাবে হয়ে গেলি? তোর বাবাওতো এত লায়েক ছিল না।
কথায় কথায় বাবার প্রসঙ্গ টানবে নাতো মা। বাবার সঙ্গে আমার তুলনা করবে না। বাবা ছিল বাবার মত আমি আমার মত।
তোর বাবার কথা উঠলেই তুই রেগে যাস কি জন্যে? আমি ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছি। তুইতো তাকে সহাই করতে পারিস না।
আমি তাকে সহ্য করতে পারি বা না পারি তাতে তো তাঁর কিছু যাচ্ছে আসছে না। তুমি কেন রাগ করছ?
এখন তোর বাবার কিছু যাচ্ছে। আসছে না। কিন্তু সে যখন ফিরে আসবে, আমাদের সঙ্গে থাকবে তখনতো যাবে আসবে।
বাবা আমাদের সঙ্গে থাকবে?
সে যাবে কোথায়?
ইমন চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বলল, তোমার এখনো ধারণা বাবা ফিরে আসবে?
অবশ্যই আসবে। আমি আলাদা বাসা নিয়েছি কি জন্যে? তোর বাবার জন্যে।
ও।
আমি চেষ্টা করছি তোর বাবা চলে যাবার সময় যে বাড়িতে ছিল সেই বাড়ি ভাড়া নিতে। বাড়িওয়ালাকে বলে রেখেছি— ঘর খালি হলেই তিনি আমাকে খবর দেবেন।
ঠিক আছে মা। তোমার যা ইচ্ছা কর।
মুন্নী মেয়েটার ব্যাপারে তুই ভেবে দেখা।
মা আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমুব।
অবশ্যই ফিরবে। তাকে ফিরতেই হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তোর বাবা ফিরে আসবে শুনে তুই মনে হয় বিরক্ত হচ্ছিস?
মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না। মা। আমার আনন্দ হচ্ছে।
তোকেতো চিনতেই পারবে না। এতটুকু ছেলে রেখে গিয়েছিল ফিরে এসে দেখবে এত বড় জোয়ান ছেলে।
সুরাইয়া হাসছেন। ইমন তাঁর মার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।
ইমনের ঘুম আসছে না। মার সঙ্গে কথা বলে মাথা কেমন জানি করছে। চোখ জ্বালা করছে। একবার ঘুম আসবে না জানা হয়ে গেলে বিছানায় শুয়ে থাকা খুব কষ্টকর হয়। ইমন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। বাকি রাতটা জেগেই কাটাতে হবে। চিঠি লিখলে কেমন হয়? ছোট চাচাকে একটা চিঠি লেখা যায়। তবে তিনি আবারো ঠিকানা বদলেছেন। চিঠি লিখলেও পাঠানো যাবে না। অবশ্যি চিঠি যে পাঠাতেই হবে এমনতো কথা নেই। চিঠি লেখাটাই প্রধান। পাঠানোটা প্রধান না। আচ্ছা সুপ্ৰভাকে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়? সুপ্ৰভা কোনদিন পড়তে পারবে না, আবার পড়তেওতো পারে। জগৎ রহস্যময়, সেই রহস্যময় জগতে কত কিছুই ঘটতে পারে। সে চিঠি লেখার সময় অশরীরি সুপ্ৰভা হয়ত উঁকি দিয়ে দিয়ে পড়বে। নিজের মনে পড়বে। আচ্ছা তারও কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
ইমন কাগজ কলম নিয়ে বসল। সম্বোধন কি হবে।— প্রিয় সুপ্ৰভা? না, প্রিয় লেখার দরকার নেই। যে প্ৰিয় তাকে প্ৰিয় সম্বোধন করার প্রয়োজনটা কি? আমরা যখন অপ্ৰিয় কাউকে চিঠি লিখি তখন কি লিখি অপ্ৰিয় করিম বা অপ্রিয় রহিম? ইমন কাগজের উপর ঝুকে পড়ল। চিঠিটা এমন করে লিখতে হবে যেন সুপ্ৰভা পড়ে মজা পায়। আচ্ছা এসব সে কি ভাবছে? সুপ্ৰভা পড়বে কি ভাবে যে মজা পাবে?
সুপ্ৰভা,
তুই কেমন আছিস? মনের আনন্দে খুব ঘুরে বেড়াচ্ছিস? চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, স্কুলের ঝামেলা নেই।
তোর কথা খুব মনে হয়। আমি যখনই একা থাকি তখনি দুজন মানুষের কথা মনে হয়–একজন ছোট চাচা, আরেকজন তুই।
আর যখন অসুখ বিসুখ হয় তখন ছোট চাচা না, তখন শুধু তোর কথা মনে হয়। তোর যে অভ্যাস ছিল অসুখ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেই গল্পের বই পড়ে শুনানো। অসুখের সময় কিছু ভাল লাগে না। মাথায় যন্ত্রণা হয়। তখন কি আর গল্প শুনতে ভাল লাগার কথা? আমার কখনো ভাল লাগত না। তুই এত আগ্রহ করে গল্প পড়ে শুনাতি বলে চুপ করে থাকতাম।
কয়েকদিন আগে জ্বরে পড়েছিলাম। গায়ে হামের মত গোটা গোটা কি যেন বের হয়েছিল। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। তখন তোর কথা খুব মনে পড়ছিল।
এখন আমাদের খবর বলি। শোভন ভাইয়াকে পুলিশ ধরে থানা হাজতে আটকে রেখেছে। আমি প্রায়ই তাকে দেখতে যাই—সিগারেট দিয়ে আসি। শোভন ভাইয়া সেদিন হঠাৎ বললেন, তোকে না-কি স্বপ্নে দেখেছেন। স্বপ্নটাও অদ্ভুত। তিনি হাজতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মশার হাত থেকে বাঁচার জন্যে নাক মুখ সব কম্বলে ঢাকা। হঠাৎ কে যেন টান দিয়ে কম্বল সরাল।
তিনি জেগে উঠে দেখেন— তুই। তিনি বললেন, সুপ্ৰভা তুই এখানে কেন? হাজতে এসেছিস কি মনে করে? তুই হাসতে হাসতে বললি, তোমাকে দেখতে এসেছি। শোভন ভাইয়া দারুণ রেগে গিয়ে বললেন, তুই তোর বিশ্ৰী অভ্যাসটা বদলা। যেখানে সেখানে উপস্থিত হবি। তুই একটা বাচ্চা মেয়ে, হাজতে তুই আসবি কেন?
তুই বললি, তোমাকে নিতে এসেছি ভাইয়া। এসো আমার সঙ্গে।
তিনি বললেন, এরা আমাকে যেতে দেবে না।
তুই বললি, অবশ্যই যেতে দেবে। আমার হাত ধর।
তিনি তোর হাত ধরতেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।
স্বপ্নটা সুন্দর, কিন্তু তার কাছে মনে হল তিনি একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছেন। এটা নাকি মৃত্যু স্বপ্ন। কোন মৃত মানুষ যদি স্বপ্নে দেখা দিয়ে হাত ধরতে বলে এবং সেই হাত যদি ধরা হয় তাহলে ধরেই নিতে হবে অবধারিত মৃত্যু।