বেপারী কে?
আব্দুল কুদ্দুস বেপারী। ঐ হারামজাদা আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে। হারামীর বাচ্চাকে আমি শিয়ালের শিং দেখাব। হারামী দেখবে শিয়ালের শিং কেমন। হরিণের মত ডালপালাওয়ালা, না-কি গরুর মত প্লেইন।
ইমন চুপ করে রইল। শোভন গলা নামিয়ে বলল, ভয় পাস না। ভয়ের কিছু নেই। তোর কাছে এই জিনিস আছে এটা কেউ সন্দেহ করবে না। মা
কেমন আছে?
জানি না। অনেক দিন যাই না।
যাস না কেন? মাঝে মধ্যে যাবি। মা কি জানে। আমি ধরা খেয়েছি?
মনে হয় জানেন না।
না জানলেই ভাল। নষ্ট ছেলে পুলে সম্পর্কে যত কম জানা যায় ততই ভাল।
তোমার কেইস আদালতে কবে যাবে?
দেরী আছে। পুলিশকে আগে কেইস সাজাতে হবে। পুলিশের এত সময় কোথায়? তাদের সব গুছিয়ে আনতে বছর দুই সময় লাগবে। এই দুই বছরে কত কি হবে। আলামত হারিয়ে ফেলবে। সাক্ষি ট্যাপ খেয়ে যাবে। ফাইল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ইমন কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, তুমি কি খুন করেছ?
শোভনের দ্বিতীয় সিগারেটটিও শেষ হয়েছে। শিকের বাইরে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে সে আরেকটি সিগারেট হাতে নিল, ধরাল না। ইমনের ধারণা হল শোভন প্রশ্নের উত্তর দেবে না। প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াও এক ধরণের উত্তর। তবে ইমনের ধারণা ভুল প্রমাণ করে শোভন বলল, খুন করেছি। একা করিনি, সঙ্গে আরো লোকজন ছিল। এইসব নিয়ে তুই মাথা ঘামাবি না। সবই কপালের লিখন। যার কপালে যা লেখা থাকে তার তাই হয়। যা চলে যা।
গভীর রাতে সুরাইয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল
গভীর রাতে সুরাইয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোন কারণ ছাড়াই তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তাঁর কাছে মনে হল বাড়িঘর একটু যেন দুলছে। ঘরের পর্দা কাঁপছে। ভূমিকম্প না-কি? ইমনকে ডাকতে যাবেন-তখন তাঁর শরীর জমে গেল। বিছানায় সুপ্ৰভা শুয়ে আছে। কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। ছোটবেলার মত করে ঘুমুচ্ছে—বুড়ো আঙ্গুল মুখের ভেতর। আঙ্গুল চুষতে চুষতে ঘুম। বড় হয়েও এই অভ্যাস যায় নি। কত মার খেল এই জন্যে। সুরাইয়া ভাঙ্গা গলায় ডাকলেন, ইমন ইমন। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। তিনি ফুসফুসের সমস্ত শক্তি একত্র করে ডাকলেন, ইমন ইমন। তিনি সুপ্রভার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরাতে পারছেন না। মেয়েটা ঘুমুচ্ছেও না। এইত চোখ মেলে আবার চোখ বন্ধ করল। সুপ্ৰভা কোথেকে এল?
দরজায় ধাক্কা পড়ছে। ইমনের গলা শোনা যাচ্ছে—মা কি হয়েছে? দরজা খোল। দরজা খোল মা।
সুরাইয়া খাট থেকে নামলেন। মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন, দেয়াল ধরে টাল সামলালেন। কোন রকমে দরজার কাছে গেলেন। আবারো তাকালেন খাটের দিকে—ঐতো সুপ্রভা। পা গুটিয়ে শুয়েছিল, এখন পা সোজা করেছে।
মা দরজা খোল।
সুরাইয়া দরজা খুললেন। ইমন বলল, কি হয়েছে? সুরাইয়া তাকালেন খাটের দিকে। খািট শূন্য। কেউ সেখানে শুয়ে নেই। ইমন বলল, কি হয়েছে?
সুরাইয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, ভয় পেয়েছি।
ভয় পেয়েছ। কেন?
মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে।
মা শুয়ে থাক, ভূমিকম্প হচ্ছে না।
তুই আমার সঙ্গে ঘুমো।
ইমন বিরক্ত গলায় বলল, পাগলের মত কথা বলো নাতো মা।
পাগলের মত কথা কি বললাম? ছেলে মার সঙ্গে ঘুমুতে পারে না।
একটা জোয়ান ছেলে মার সঙ্গে শুয়ে থাকবে এটা কেমন কথা?
মার কাছে ছেলে সব সময়ই ছেলে।
তোমার সঙ্গে ডিবেট করতে ভাল লাগছে না। মা! তুমি ঘুমাও আমি যাচ্ছি।
এ রকম বিরক্ত গলায় কথা বলছিস কেন? তোর বাবাতো জীবনে কখনো আমার সঙ্গে এমন বিরক্ত গলায় কথা বলে নি।
বাবা যদি এখন থাকতো তাহলে আমার চেয়ে অনেক বেশী বিরক্ত হত। তুমি আগে যেমন ছিলে এখন তেমন নেই। তুমি বদলে গেছ।
আমাকে ধমকাচ্ছিস কেন?
ধমকাচ্ছি না। তোমাকে ধমকাব এত সাহস আমার নেই।
ইমন চলে গেল। সুরাইয়া আবারো ভয়ে ভয়ে খাটের দিকে তাকালেন। না, খাটে কেউ নেই। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন। পানির পিপাসা হয়েছে পানি খাবেন। মাথা দীপ দাপ করছে। নারিকেল তেলের সঙ্গে পানি মিশিয়ে মাথায় দিতে হবে। ঘরে কি নারিকেল তেল আছে? মনে করতে পারছেন না।
সুরাইয়া পানি খেলেন। মাথায় পানি দিয়ে চুলা ধরালেন। বাকি রাতটা তিনি জেগেই কাটাবেন। একা একা বিছানায় ঘুমুতে যাবার মত সাহস তাঁর নেই। চা নিয়ে বসার ঘরে চলে যাবেন। মোটাসোটা দেখে একটা গল্পের বই নিয়ে বসতে পারলে হত। গল্পের বই কি আছে? ইমনের কাছে থাকতে পারে। সুরাইয়া ইমনের জন্যেও এক কাপ চা বানালেন। মনে হয় খাবে না। না খেলে তিনি নিজেই পরে গরম করে খেয়ে নেবেন।
ইমনের ঘরের দরজার কড়া নাড়তেই ইমন দরজা খুলল। সুরাইয়া বললেন, চা খাবি?
ইমন কোন কথা না বলে চায়ের জন্যে হত বাড়াল। সুরাইয়া বললেন, তোর কাছে কোন গল্পের বই আছে?
এত রাতে গল্পের বই দিয়ে কি হবে?
রাতে আর ঘুমুতে যাব না। এই জন্যে।
ভূমিকম্পের ভয়ে জেগে থাকবে?
ভূমিকম্প না। অন্য ব্যাপার।
অন্য ব্যাপারটা কি?
সুরাইয়া ছেলের ঘরের বিছানার উপর চায়ের কাপ নিয়ে বসতে বসতে বললেন— হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি কি বিছানায় সুপ্ৰভা ঘুমুচ্ছে।
এটাতো নতুন কিছু না মা। এক সময় তুমি দেখতে বাবা তোমার পাশে ঘুমুচ্ছে।
তোর বাবাকে দেখে কখনো ভয় পেতাম না। সুপ্ৰভাকে দেখে ভয় পেয়েছি।
সুপ্ৰভাকে কি আজই প্রথম দেখলে না। আগেও দেখেছ?
সুরাইয়া জবাব দিলেন না। তিনি অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছেন। ব্যাপারটা ছেলেকে এই মুহুর্তে বলা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। সুরাইয়া হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তিনি ছেলেকে কিছুটা হলেও ভয় পান। আশ্চর্য নিজের পেটের ছেলেকে তিনি ভয় পাচ্ছেন। ঐতো সেদিন এতটুকু ছিল। সিঁড়ি দিয়ে একা নামতে পারত না। কেমন পা লেছড়ে লেছড়ে নামত।