না ভুলে যাইনিতো। আমার খুব মনে আছে। আপনাকে মিথ্যা করে বলেছি। ভুলে গেছি। স্যার খেয়ে দেখুনতো কেমন হয়েছে। যেটা দেখতে আলুভতাঁর মত সেটা আসলে আলু ভর্তা না, বুটের ডালের হালুয়া।
ইমন হালুয়া মুখে দিল। জিনিসটা দেখতে অখাদ্য হলেও খেতে ভাল হয়েছে।
নবনী বলল, আপনার জন্যে সামান্য গিফটও এনে রেখেছি স্যার। যাবার সময় নিয়ে যাবেন।
গিফট কি জন্যে?
আজ আপনার জন্মদিন।
কে বলল তোমাকে?
মিতু আপা বলেছেন। অনেক আগেই মিতু আপার কাছ থেকে আপনার ডেট অব বাৰ্থ জেনে নিয়েছি। স্যার হ্যাপী বাৰ্থ ডে।
ইমন গম্ভীর গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু।
স্যার আপনি সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকেন। প্লীজ—জন্মদিনের দিন গম্ভীর হয়ে থাকবেন না। পায়েসটা খান। পায়েসটা খুব ভাল হয়েছে। কাওনের চালের পায়েস।
ইমন পায়েসের বাটি হাতে নিল। আজ তার জন্মদিন ঠিকই। তারিখ তার নিজেরই মনে ছিল না।
হ্যাঁ।
পায়েস বানানো আমি আজই শিখেছি। মাকে বললাম, মা পায়েস বানানো শিখিয়ে দাও। মা শিখিয়ে দিল। পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইনস্ট্রাকসন দিল-আমি রাধলাম।
পায়েসটা বেশ ভাল হয়েছে।
মা বললেন, এত যত্ন করে পায়েস রাধছিস কার জন্যে-আমি বললাম স্যারের জন্যে। ওমি মার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। মা আপনাকে।্য করতে পারে না।
কেন?
মার ধারণা আমি আপনাকে মার চেয়ে বেশি পছন্দ করি এই জন্যে। তবে মার পছন্দে কিছু যায আসে না। বাবার পছন্দ অপছন্দটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই বাড়ির স কিছু চলে বাবার চোখের ইশারায়। বাবা যদি কোন একটা ব্যাপারে হ্যাঁ বলেন—তাহলে পৃথিবীর কেউ সেই হ্যাকে না বানাতে পারবে না।
ও আচ্ছা।
আর সেই কঠিন বাবাকে কে কনট্রোল করে বলুনতো?
তুমি করা?
হ্যাঁ, আমি করি। আমি বাবাকে যা করতে বলব, বাবা তাই করবে।
ভালতো।
ঐ দিন আমি বাবাকে বললাম, বাবা। আমি কিন্তু নিজের ইচ্ছামত বিয়ে করব। আমি যদি কাউকে পছন্দ করি তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না। বাবা হাসিমুখে বললেন—আচ্ছা না বলব না। পছন্দের কেউ ইতিমধ্যেই কি জোগাড় হয়ে গেছে? আমি বললাম, হুঁ। বাবা বললেন, তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিবি না? আমি বললাম, দেব।
ইমন বলল, নবনী আজ থাক। অন্য একদিন পরিচয় করব। আজ আমার ইমনের চা খাওয়া হয়ে গেছে।
সে উঠতে যাবে নবনী বলল, স্যার উঠবেন না। বাবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দি। আপনি এতদিন ধরে আমাকে পড়াচ্ছেন। কিন্তু এখনো বাবার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি। আজ বাবা বাসায় আছেন, ঘুমুচ্ছেন। ঘুম ভাঙ্গলেই বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।
ইমন বলল, নবনী আজ থাক। অন্য একদিন পরিচয় করব। আজ আমার একটা কাজ আছে।
বাবার ঘুম এক্ষুণি ভাঙবে। চারটার পর বাবা বিছানায় থাকেন না। এখন বাজছে চারটা দশ।
ইমন দাঁড়িয়ে পড়ল। নবনী আহত গলায় বলল, স্যার আপনি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। আমার জরুরী কাজ আছে।
কি জরুরী কাজ?
আমার এক ভাইকে পুলিশে ধরেছে। সে থান সাজতে আছে—তার সঙ্গে দেখা করব।
আপনার ভাই থানা হাজতে? উনি কি করেছেন?
অনেক কিছু করেছে।
পুলিশের এডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল আমার মেজো মামা। উনাকে বলব?
না তাকে কিছু বলতে হবে না।
আপনার গিফটটা নিয়ে যান।
আরেকদিন এসে নিয়ে যাব। গিফট নিয়ে হাজতে যাওয়া যায় না, তাই না?
স্যার—আসুন আপনাকে একটা গাড়ি দিয়ে দি। গাড়ি নিয়ে যাবেন।
গাড়ি লাগবে না।
ইমন ঘর থেকে বের হল। নবনীর চোখ সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। সে যে তার স্যারের জন্যে এই প্ৰথম চোখের পানি ফেলল তা না। প্রায়ই ফেলে। প্রতি রাতেই ঘুমুতে যাবার সময় সে বালিশে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ কাঁদে।
হাজতে গাদাগাদি ভিড়। এক কোনায় শোভন গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। তার চুল লম্বা, মুখ ভর্তি দাড়ি গোফের জঙ্গল। চোখ লাল হয়ে আছে। জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে কটকট হলুদ রঙের উইন্ড ব্রেকারে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।।
ইমন হাজাতের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। শোভনকে চিনতে পারছে না। তাকে বিস্মিত করে জঙ্গলামুখের এক যুবক বলল, ইমন সিগারেট এনেছিস। আমি যে এখানে খবর কার কাছে পেয়েছিস?
টোকন ভাইয়ার কাছে।
ও তোকে টাকা পয়সা দেয় নি?
পাঁচশ টাকার একটা নোট দিয়েছে।
মাত্ৰ পাঁচশ! বলিস কি? আমার দরকার হাজার হাজার টাকা।
তোমাকে কি ওরা মেরেছে?
প্রথম দুদিন ধোলাই দিয়েছে, এখন ধোলাই বন্ধ।
শোভন আনন্দিত মুখে সিগারেট ধরাল। পা নাচাতে নাচাতে বলল, তোর মুখ এত শুকনা কেন? তোর প্রবলেম কি?
কোন প্রবলেম নেই।
ফুপু ভাল আছেন?
হুঁ।
ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত আছে, এটা ভাল। তোর পরীক্ষা কবে?
সাত তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে।
প্রিপারেশন কেমন?
ভাল।
শোভনের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। সে আরেকটা সিগারেট ধরাল। ইমন দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। অন্যান্য হাজতিরা শুরুতে তাদের কথাবার্তা শুনছিল। এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে তারা তৃষিত চোখে তাকাচ্ছে শোভনের সিগারেটের দিকে। তাদের আগ্রহ সীমাবদ্ধ হয়ে এসেছে।
ইমন!
হুঁ।
এবারো নিশ্চয়ই ফাস্ট সেকেন্ড হবি?
হুঁ হব।
ভাল ভাল। ভেরী গুড।
তোমাকে কি এরা থানা হাজতেই রাখবো?
নিয়ম নাই। জেল হাজতে পাঠানোর কথা। পাঠাচ্ছে না। নিয়ম কানুন. সব কাগজে কলমে। তুই মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যাবি।
আচ্ছা। জিনিসটা সাবধানে রাখবি।
আচ্ছা।
কখনো হাতছাড়া করবি না। এইসব জিনিস। সচরাচর পাওয়া যায় না। যদি ছাড়া পাই, জিনিসটা লাগবে। বেপারীকে শিক্ষা দেব। জন্মের শিক্ষা।