আচ্ছা এইসব সে কি ভাবছে? ঘুম কাটাবার জন্যে ইমন রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে থামল। পর পর দুকাপ চা খেল। টাকা দিতে গিয়ে দেখে ভাংতি নেই। একটা পাঁচশ টাকার নোট। দুপ্যাকেট সিগারেট কিনলে টাকার ভাংতি পাওয়া যাবে। দুপ্যাকেট সিগারেটই দরকার। একজনকে দিতে হবে। আচ্ছা তিন প্যাকেট সিগারেট কিনলে কেমন হয়? তার নিজের জন্যে এক প্যাকেট।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানবে। মা হঠাৎ ঘরে ঢুকে আতংকিত গলায় বলবেন, কি করছিস? সে বলবে, সিগারেট খাচ্ছি মা।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে সিগারেট খেতে খেতে গল্পের বই পড়তে নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগবে। নবনীদের ঘর ভর্তি গল্পের বই।
আজ ফেরার পথে নবনীর কাছ থেকে কিছু গল্পের বই চেয়ে নিয়ে আসতে হবে। বই ধার চাইলেই সে আহ্লাদী ধরণের কোন একটা কথা বলবে। নবনী সহজ ভাবে কোন কথা বলতে পারে না। তার কাছে প্ৰকান্ড একটা কাচের জার আছে, জার ভর্তি তরল আহ্লাদী। নবনী প্রতিটি কথা বলার আগে আহ্লাদী জারে ড়ুবিয়ে বলে। নবনীকে যে ছেলে বিয়ে করবে তার প্রথম করণীয় কাজটা হচ্ছে বিয়ের রাতেই আহ্লাদীর জারটা ভেঙ্গে ফেলা। আচ্ছা এইসব সে কি ভাবছে? নবনীর আহ্লাদীতে তার কিছু যায় আসে না। নবনী যা ইচ্ছা করুক। তার দায়িত্ব নবনীকে অংক শেখানো।
নবনীকে সে সপ্তাহে তিনদিন পড়ায়-সন্ধ্যার পর এক ঘন্টা। পড়ানোর টাইম টেবিলের ঠিক নেই। হুট করে নবনী বলবে, স্যার আগামী কাল আসবেন না। পরশু দিন আসুন। দুপুর দুটার সময়। যদি আপনার কাজ না থাকে।
স্যার শুনুন, আগামী এক সপ্তাহ আসবেন না। আমরা দলবেধে টেকনাফ যাব। না গিয়ে থাকলে আমাদের সঙ্গে চলুন। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ।
ইমন ঠিক সাড়ে তিনটায় নবনীদের বাড়ির সামনে উপস্থিত হল। নবনী দরজা খুলে আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গি করে বলল, ওমা! স্যার আপনি!
ইমন বিস্মিত হয়ে বলল, তুমিতো সাড়ে তিনটার সময় আসতে বলেছিলে।
ও আল্লা আমার কি হবে? কিছু মনে নাই। আজকেও বোরিং ম্যাথ নিয়ে বসতে হবে। ছুটির দিনেও ম্যাথ?
তোমার ইচ্ছা না করলে থাক।
উহু, থাকবে কেন? এসেছেন যখন তখনতো পাশা খেলতেই হবে।
পাশা খেলতে হবে মানে কি?
পাশা খেলার গান শুনেন নি? হিট গান—আইজ পাশা খেলবারে শ্যাম। স্যার, আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বই-খাতা নিয়ে চলে আসব। এই পাঁচ মিনিট বরং খবরের কাগজ পড়ুন। আজকের কাগজ পড়েছেন।
না।
আমিও পড়ি নি। পড়তে ভাল লাগে না—সব সময় বিশ্ৰী বিশ্ৰী সব নিউজ ছাপা হয়। স্যার আমি যাই—জাস্ট ফাইভ মিনিটস।
ইমন কুড়ি মিনিট ধরে বসে আছে। নবনীর খোেজ নেই। বিশাল বাড়িতে নিজেকে ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে। বড় বড় সোফা, সোফার সামনে কাচের টেবিল। পায়ের নিচের কার্পেটটা এতই সুন্দর যে এর উপর দাঁড়াতে মায়া লাগে। ড্রয়িং রুমের দুই কোনার কাচের তিনকোণা টেবিলে দুটা শ্বেত পাথরের নারী মৃতী। গায়ের কাপড় গায়ে থাকছে না, খুলে পড়ে যাচ্ছে। মুতী দুটার দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না, আবার দৃষ্টিও ফিরিয়ে নেয়া যায় না। ইমনের নিজেকে বসার ঘরের অনেক আসবাবের মত একটা আসবাব বলে মনে হচ্ছে।
স্যার, আপনাকে চা দেয় নি। কি আশ্চর্য, আমি বলে গেলাম চা দিতে। ছিঃ ছিঃ স্যার আপনি কি রাগ করেছেন?
না। রাগ করব কেন?
একা একা এতক্ষণ বসেছিলেন এই জন্যে। কেন দেরি হয়েছে জানেন স্যার। আমি বাথরুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে বের হব। এমন সময় টেলিফোন-আমার এক বান্ধবী, ওর নাম-শম্পা, টেলিফোন করেছে। শম্পা একবার টেলিফোন ধরলে ছাড়ে না।
ইমন তাকিয়ে আছে। নবনী শম্পার সঙ্গে কথা বলছিল এটা মিথ্যা। নবনী এতক্ষণ সাজগোজ করছিল। যে সাজ সে দিয়েছে সেই সাজের জন্যে বিশ মিনিট খুব কম সময়। মেরুন রঙের সবুজ পাড় শাড়ি। মেরুন স্যান্ডেল। গাঢ় সবুজ ব্লাউজ। চুলেও কিছু একটা করা হয়েছে। ঢেউ-এর মত ফুলে আছে। চোখে কাজল দেয়া হয়েছে। নবনীর চোখ এখন যতটা টানা মনে হচ্ছে। আসলে ততটা টানা না।
নবনী বলল, স্যার কি দেখছেন?
ইমন বলল, চল পড়তে বসি।
স্যার আজ পড়ব না। এ রকম সাজগোজ করে পড়তে ভাল লাগে না। এমন সাজের পর ইটিস পিটিস করতে ভাল লাগে।
ইটিস পিটিস কি?
কিছু না স্যার। রসিকতা করলাম। আসলে কি হয়েছে জানেন-শম্পা টেলিফোন করেছে তার বাসায় যাবার জন্যে। তার বড়বোনকে বর পক্ষের লোকজন দেখতে আসবে এই উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান। আমাকে যেতে বলেছে। বলেই সেজেছি।
তাহলে তুমি যাও। আমি সোমবারে আসব।
সেখানে যাব সন্ধ্যাবেলা, সাড়ে ছটায়। এখনতো না। আপনি একদিন গল্প করুন। সবদিন অংক করতে হবে এমন কোন কথা আছে? All work and no play make Jack a dull boy. এ কথাটা আমার বাবা সব সময় বলেন। আমি যখন ফাইভ সিক্সে পড়তাম তখন খুব ভিডিও গেম খেলার শখ ছিল। বাবা তখন নিয়ম করে দিয়েছিলেন, এক ঘন্টা পড়লে এক ঘন্টা ভিডিও গেম খেলতে পারব। কাজেই আজ আমি আপনার সঙ্গে গল্প করব। একটু বসুন আপনার জন্যে চা নিয়ে আসি।
নবনী পট ভর্তি করে চা নিয়ে এল। একটা বাটিতে পায়েস, একটা বাটিতে হালুয়া জাতীয় কিছু, অন্য একটা প্লেটে আলুর চাপ।
স্যার, এই যে খাবারগুলি দেখছেন সব আমার বানানো। আজ সারাদিন কষ্ট করে বানিয়েছি—আপনাকে খাওয়াব এই জন্যে।
ইমন বিরক্ত মুখে বলল, আমি যে আসব সেটাইতো তুমি ভুলে গিয়েছিলে।