ইমন ফিস ফিস করে বলল, খুব ভাল লাগছে। আসলে গল্পটা তার মোটেই ভাল লাগছে না। বাঘের চোখের মালার কথা ভাবতেই তার ঘেন্না লাগছে। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে—অনেকগুলি বাঘ গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের কারোরই চোখ নেই। ভয়ংকর এক রাজপুত্র তাদের চোখ উপড়ে নিয়েছে। অন্ধ বাঘের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
তাহলে শোন—বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধারের জন্যে এক রাজপুত্র বের হল বাঘের সন্ধানে। তার খুব সাহস। সে দেখতেও খুব সুন্দর।
মা তার নাম কি?
ও আচ্ছা, তার নামতো বলা হয়নি। রাজপুত্র যেমন সুন্দর তার নামটাও খুব সুন্দর–রাজপুত্রের নাম ইমন কুমার। নামটা সুন্দর না।
ইমনের খুব লজ্জা লাগছে। রাজপুত্রের নাম আর তার নাম একই। ইমনের খুব ইচ্ছা করছে মার গায়ে হাত রেখে শুয়ে থাকতে। সেটা সম্ভব নামাঝখানে সুপ্ৰভা শুয়ে আছে।
ইমন।
হুঁ।
বাবা ঘুমাও। আমার গল্প বলতে আর ভাল লাগছে না।
সুরাইয়ার শুধু যে ভাল লাগছে না তা না, তার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। সে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল গল্পের মাঝখানে ইমন বলবে–মা, এই গল্পটা আমি জানি। তুমি অন্য গল্প বল। এই গল্প ইমনের বাবা ইমনকে বলেছিলেন। ছেলের সেই গল্পের কথা মনে নেই। বাবাকে এত দ্রুত সে ভুলে যাচ্ছে। এত দ্রুত?
নিজেকে ইমনের খুব বড় মনে হচ্ছে
নিজেকে ইমনের খুব বড় মনে হচ্ছে। যেন হুট করে একদিনে অনেক বড় হয়ে গেছে। সে সবাইকে রেখে একা একা গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। ছোট চাচা অবশ্যি সঙ্গে যাচ্ছেন তারপরেও সে একা একা যাচ্ছে—এটা ভাবা যায়! ইমনের হাতে ছোট্ট ব্যাগ। ব্যাগে জামা কাপড়। টুথপেষ্ট, টুথব্রাস। একটা চিরুনী।
সুরাইয়া ছেলের হাতে দুটা দশ টাকার নোট দিল। ইমন সেই নোট দুটা গম্ভীর ভঙ্গিতে সার্টের পকেটে নিল। সুরাইয়া বলল, খুব সাবধানে থাকবে।
ইমন মাথা কাত করল।
গ্রামে অনেক পুকুর-টুকুর আছে। সাবধান, একা একা পুকুরে যাবে না। জঙ্গল টঙ্গলেও যাবে না, সাপ খোপ আছে। মনে থাকবে?
হুঁ।
আচ্ছা তাহলে যাও। রাতে ছোট চাচার সঙ্গে থাকবে। বাথরুম পেলে তাকে জাগাবে—গ্রামের বাথরুম দূরে হয়
আচ্ছা।
বাহ, আমাদের ইমন কুমারকেতো খুব স্মার্ট লাগছে। কাছে এসো কপালে চুমু খেয়ে দি।
ইমন কাছে গেল। মা যখন কপালে চুমু খেলেন তখন হঠাৎ তার মনে হল–মা কে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। গ্রামেব বাড়িতে না গেলেই সবচে ভাল হয়। ইচ্ছাটা হল খুব অল্প সময়ের জন্যে।
টেনে উঠে ইমনের মনে হল সে শুধু বড় না, অনেক বড় হয়ে গেছে। কারণ ছোট চাচা তার ট্রেনের টিকিট তার হাতে দিয়েছেন। টিকিট দেয়ার সময় বলেছেন–হারাবি না, হারালে টিকেট চেকার ফাইন করে দেবে। ইমনকে ছোট চাচার কোলে বসতে হল না। তার জন্যে জানালার কাছে আলাদা সীট। ছোট চাচা চা খেলেন, সেও খেলো। ঠিক বড়দের মত আলাদা কাপে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখতে তার কি যে ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল সে সারাজীবন টেনে কাটিয়ে দিতে পারবে। এরমধ্যে ছোট চাচা বললেন–এই যে মিষ্টার হার্ড নাট। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব। তোর দায়িত্ব হচ্ছে ষ্টেশনের নোম পড়তে পড়তে যাওয়া। যখন দেখবি ষ্টেশনের নাম নান্দাইল রোড তখন আমাকে ডেকে তুলবি। ট্রেন ষ্টেশনে ঢুকতেই জানোলা দিয়ে মাথা বের করে ষ্টেশনের নোম পড়া কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার।
গ্রামের বাড়ি দেখে ইমন আনন্দে অভিভূত হল। কি অদ্ভুত বাড়ি। টিনের চাল। ছোট ছোট জানালা। চারদিকে এত গাছপালা যেন মনে হয়। জঙ্গলের ভেতর বাড়ি। একটা কুমড়ো গাছ বাড়িটার চালে উঠে গেছে। সেই গাছ ভর্তি কুমড়ো। উঠোনে সত্যিকার একটা মা ভেড়া চারটা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। ইমন যখন তার সামনে দাঁড়াল ভেড়াটা একটুও ভয় পেল না। বাচ্চা ভেড়াদের একটা আবার এসে ইমনের গা শুকতে শুরু করল।
বিস্ময়ের উপর বিস্ময় বাড়িতে দুটা রাজ হাঁস। তারা গলা উঁচু করে কি গম্ভীর ভাবে হাঁটছে। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ছোট চাচা অবশ্যি বললেন, রাজ হাঁস দুটা খুবই ত্যাদড়। খবরদার কাছে যাবি না। কামড় দেয়। কি অদ্ভুত কথা, হাঁস আবার মানুষকে কামড় দেয়। হাঁস কি কুকুর না-কি যে কামড়াবে?
আকলিমা বেগম নাতীকে দেখে ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদেন আর একটু পর পর বলেন, আমার ইমাইন্যা আইছে। তোমরা কে কই আছ— দেইখ্যা যাও আমার ইমাইন্যা আইছে। দাদীর কান্না দেখে ইমনের লজ্জা লাগছে–আবার ভালও লাগছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এমন বুড়ো একজন মানুষ তার মত ছোট্ট একজনকে এত ভালবাসে কেন। দাদীজানের শরীর অবশ। শুধু ডান হাতটা নাড়াতে পারেন। সেই হাতে তিনি ইমনকে ধরে আছেন। কিছুতেই ছাড়ছেন না। হাতে ন্যাপথলিনের গন্ধ। বুড়ো মানুষদের হাতে কি ন্যাপথালিনের গন্ধ হয়?
ইমনের সারাটা দিন কাটল ভয়াবহ উত্তেজনায়। দুবার তাকে রাজহাঁস তাড়া করল। এতে ভয় যেমন লাগছিল মজাও লাগছিল।
বড়ই গাছে উঠে সে নিজের হাতে পাকা বড়ই পেড়ে খেলো। বড়ই গাছে নিজে নিজে ওঠা কঠিন। তবে ছোট চাচা একটা টেবিল এনে গাছের সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন। টেবিল থেকে চট করে গাছে ওঠা যায়। তবে খুব বেশী দূর ওঠা যায় না। গাছ ভর্তি কাঁটা।
ছোট চাচা কামরাঙ্গা গাছের ডালে একটা দোলন টানিয়ে দিলেন। খুব অদ্ভুত দোলন–চেয়ার দোলনা। একটা চেয়ারের হাতলের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝলিয়ে দেয়া! কি যে মজার দোলনা। মনে হয় চেয়ারে বসে আছে, সামনে টেবিল। চেয়ার এবং টেবিল দুটাই দুলছে।