ইমন বলল, না।
পেনসিল পাওনি তাহলে এসেছ কেন? বললাম না, পেনসিল না পেলে আসবে না। কথা কানে যায় না? বাঁদর ছেলে।
রাত দশটার মত বাজে। অন্যদিন এই সময়েও বাড়ি গমগম করে, আজ মনে হয় সবাই শুয়ে পড়েছে। বাড়ি নিঝুম। ইমন কি করবে বুঝতে পারছে না। এ বাড়িতে যদি ছোট চাচা থাকতেন তাহলে তাকে কানে কানে বললেই–যত রাতই হোক তিনি দোকান থেকে পেনসিল কিনে আনতেন। ছোট চাচা নেই। এখন যে সে কাঁদছে, ভয়ে কাঁদছে না–ছোট চাচার জন্যে কাঁদছে। কান্দতে কাঁদতেই তার মনে হল–বাবা থাকলে বাবা কি তার পেনসিল কিনে আনতেন? বলা যাচ্ছে না। বাবা কেমন ছিলেন, তিনি কি করতেন সে দ্রুত ভুলে যাচ্ছে। বাবার চেহারাও এখন তার মনে নেই, শুধু মনে আছে। বাবা খুব ফর্সা ছিলেন। আগের বাড়িতে বাবা-এবং মার একটা ছবি ছিল ড্রেসিং টেবিলে সাজানো। সেই ছবিটা এ বাড়িতেও নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু মা ট্রাংকে রেখে দিয়েছেন। ছবিটা সাজানো নেই। ছবি সাজানো থাকলে সে মাঝে মাঝে দেখত।
কে? কে বসে আছে?
ইমন চমকে উঠল— মিতু। অন্ধকারে পা টিপে টিপে কখন যে সামনে এসেছে সে বুঝতেই পারেনি।
ক্যাবলা, তোর কি হয়েছে?
চোখ মুছতে মুছতে ইমন বলল, পেনসিল হারিয়ে ফেলেছি।
পেনসিল হারিয়ে ফেললে এখানে বসে কাঁদছিস কেন?
ইমন জবাব দিল না। মিতু বলল, ফুপু বকা দিয়েছে?
হুঁ।
কি বলেছে পেনসিল না পেলে ঘরে ঢুকতে পারবি না!
হুঁ।
কি রঙের পেনসিল?
হলুদ।
আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি। একটা কথা শোন, তোর যদি কিছু হারিয়ে যায় আমাকে বলবি আমি এনে দেব। একা একা বসে কাঁদবি না।
ইমন ধরা গলায় বলল, আচ্ছা।
মিতু দুটা পেনসিল এনে দিল—একটা হলুদ, একটা সবুজ। হলুদটা স্কুল ব্যাগে রাখবে, সবুজটা কোথাও লুকিয়ে রাখবে। যদি আবারো পেনসিল হারায় তখন কাজে লাগবে।
সুরাইয়া ইমনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, পেনসিল পাওয়া গেছে? ইমন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সুরাইয়া বলল, আবার যদি কিছু হারায় টেনে তোমার কান আমি ছিড়ে ফেলব, বাঁদর ছেলে। আমি বাবার নাম ভুলিয়ে দেব। বাবা নেই, বাবার নাম মনে রেখে কি হবে? যাও হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে আস।
ইমন বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘুমুতে এল। আগে মাঝখানে ঘুমুতেন। সুরাইয়া, তারা দুই ভাই বোন দুপাশে ঘুমুতো। এক রাতে সুপ্ৰভা গড়াতে গড়াতে খাট থেকে পড়ে গেল। তার পর থেকে সুপ্ৰভা মাঝখানে শোয়। শোয়ার এই ব্যবস্থােটা তার খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে সুপ্ৰভাকে হাত দিয়ে ছোয়া যায়। সুপ্ৰভা যখন জেগে থাকে তখন তাকে হাত দিয়ে ছুলে খুব মজার একটা কাণ্ড হয়, সুপ্ৰভা খিল খিল করে হাসতে থাকে। সেই হাসি আর থামে না। যে কেউ হাত দিয়ে ছুলে সুপ্ৰভা এমন করে না। শুধু ইমান হাত দিয়ে ছুলেই এমন করে। যেন তার হাতে হাসির কোন ওষুধ আছে। ইমন নিজে যখন সুপ্রভার মত ছোট ছিল তখন সেও কি এরকম করতো? মাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। ছোট চাচাকে জিজ্ঞেস করতে
হবে।
ইমন।
জ্বি মা।
স্কুলে পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
ভাল।
আকাশ ইংরেজী কি?
স্কাই।
বানান কর।
এস কে ওয়াই।
আকাশ নীল ইংরেজী কি?
দ্যা স্কাই ইজ ব্লু।
মাঝে মাঝে যে আমি তোমার উপর খুব রাগ করি তখন কি মন খারাপ হয়?
না।
মিথ্যা কথা বলছি কেন? যদি মন খারাপ হয় বলবে, মন খারাপ হয়। কি হয়?
হ্যাঁ হয়।
শোন, আমি নিজে নানান দুঃখ কষ্টে থাকিতো এই জন্য এমন ব্যবহার করি। আদর করা কি জিনিস ভুলে গেছি। যে আদর পায় না, সে আদর করতেও পারে না। বুঝতে পারছি?
হুঁ।
তোমার বাবাও কিন্তু আদর করতে পারত না। সব মানুষ সব কিছু পারে না। তোমার বাবা কি ভাবে তোমাকে আদর করত মনে আছে?
না।
সে অফিস থেকে এসে তোমাকে কোলে নিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটাহাঁটি করত— এইটাই তার আদর। চুমু খাওয়া, কিংবা উপহার কিনে দেয়া এইসব তার স্বভাবে ছিল না। তুমি বড় হয়ে কার মত হবে তোমার বাবার মত হবে?
না।
তাহলে কার মত হবে?
ছোট চাচার মত।
কেউ কারো মত হতে পারে না। সবাই হয় তার নিজের মত। তুমি হাজার চেষ্টা করেও তোমার ছোট চাচার মত হতে পারবে না, কিংবা তোমার বাবার মত হতে পারবে না। সব মানুষই আলাদা।
কচ্ছপ, কচ্ছপরাও কি আলাদা?
হঠাৎ কচ্ছপের কথা এল কেন? আর কোন কথা না, ঘুমাও।
আচ্ছা।
ও ভালকথা, তোমার ছোট চাচা তোমাকে নিয়ে দেশের বাড়িতে বেড়াতে যেতে চায়। তুমি কি যেতে চাও?
আনন্দে ইমনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। তার ইচ্ছা করছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে। এমন চিৎকার যেন সুপ্রভারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভয় পেয়ে সেও যেন কাঁদতে থাকে।
কথা বলছি না কেন, যেতে চাও না?
চাই।
একা একা যেতে ভয় লাগবে না?
না।
আমাকে ফেলে রেখে যাবে কষ্ট হবে না?
না।
সেকি —আমাকে, সুপ্ৰভাকে ফেলে চলে যাচ্ছ, কষ্ট হবে না?
সুপ্রভার জন্যে হবে। সুপ্ৰভাকে তোমার আদর লাগে?
হুঁ।
আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে, এখন ঘুমাও। না-কি একটা গল্প শুনতে চাও?
ইমন গল্প শুনতে চাচ্ছে না, কিন্তু বুঝতে পারছে কোন একটা অদ্ভুত কারণে তার মার মন খুব ভাল। মা গল্প বলতে চাচ্ছেন। সেই অদ্ভুত কারণটা কি?
গল্প শুনতে চাও?
চাই।
একদেশে ছিল এক রাজ কন্যা। রাজকন্যা ছিল বন্দিনী। তার জীবনটা কাটছিল চারদেয়ালের মধ্যে। তার মুক্তির একটাই পথ—যদি কোন সাহসী রাজপুত্ৰ বাঘের চোখ দিয়ে মালা গেথে রাজকন্যার গলায় পরিয়ে দেয়। তবেই রাজকন্যা মুক্তি পাবে। গল্পটা কেমন লাগছে ইমন?