নতুন চিন্তা ভাবনাটা কি? আমাকে বিয়ে দেবার কথা ভাবছেন?
যদি ভাবি–অসুবিধা কোথায়? তোর বয়স অল্প, সারাটা জীবন পড়ে আছে সামনে।
সুরাইয়া হতভম্ব গলায় বলল, ইমনের বাবা বেঁচে থাকতেই আমি আরেকটা বিয়ে করে ফেলব?
বেঁচে আছে তোকে কে বলল?
মরে গেছে সেটাই বা কে বলল? তা ছাড়া আমি জানি বেঁচে আছে। আর যদি নাও থাকে–বিয়েতো আমি করব না।
খুব ভাল একটা ছেলে পেয়েছিলাম। ইণ্ডেটিং-এর ব্যবসা করে। বয়স অল্প। রোড অ্যাকসিডেন্টে স্ত্রী মারা গেছেন।
আপনি চান আমি আমার দুই বাচ্চা নিয়ে তার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ি?
ভাইজান যখন আপনার মনে হবে আমাদের আর পালতে পারছেন না, অসুবিধা হচ্ছে, তখন বলবেন আমি চলে যাব।
কোথায় যাবি?
কোথায় যাব সেটা আমার ব্যাপার। ভাইজান এখন আপনি যান, আমার এমন মাথা ধরেছে যে ইচ্ছা করছে দেয়ালে মাথা ঠুকি।
জামিলুর রহমান সাময়িক ভাবে উঠে চলে যান। তবে কিছুদিন পর আবারো আরেকটি ছেলের সন্ধান নিয়ে উপস্থিত হন—
বুঝলি, ভদ্রলোকের বয়স সামান্য বেশী। মনে হয়। ফিফটি ক্রস করেছে তবে ভাল স্বাস্থ্য। চেহারাও সুন্দর। দেখলে মনে হয় বয়স থাটি ফাইভ, থাটি সিক্স। হাইলি এড়ুকেটেড। ইলীনয় ইউনিভার্সিটি থেকে এম. এস. করেছে। আমেরিকান এক মেয়ে বিয়ে করেছিল। বিয়ে টিকে নি। আমেরিকান মেয়ে বুঝতেই পারছিস–বিয়েটা ওদের কাছে একটা খেলা। কিছু দিন Honey Honey বলা তারপর সোপ-নেউলের খেলা।
মেয়ে না, আমি বাঙ্গালী মেয়ে এবং বিয়েটা আমার কাছে খেলা না। আমার একবার বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী আমাকে তালাকও দেয় নি—মরেও যায় নি। আমি আবার বিয়ে করব কেন?
কোন স্বামী যদি দুই বছর তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে নিরুদেশ থাকে তাহলে সেই বিয়ে অটোমেটিক্যালি তালাক হয়ে যায়।
কে বলেছে?
মওলানা সাহেব বলেছেন।
মওলানা সাহেবদের বিয়ে হয়ত তালাক হয়ে যায়। ইমনের বাবাতো মাওলানা না।
ইমনের বাবা বেঁচে আছেন, তিনি একদিন ফিরে আসবেন এই বিষয়টা সুরাইয়া মনে প্ৰাণে বিশ্বাস করে। সুরাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একজন বিশ্বাস করে সে সুরাইয়ার ভাবী–ফাতেমা।
জামিলুর রহমান যেমন অতিরিক্ত চালাক, তার স্ত্রী ফাতেমা তেমনি অতিরিক্ত বোকা। জগতের বোকারা ভালমানুষ ধরনের হয়। ফাতেমা বেগম তা না। ভােলমানুষী কোন ব্যাপারই তার মধ্যে নেই। সুরাইয়া তার পুত্র কন্যা নিয়ে এই সংসারে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছে–এই ব্যাপারটা তার কাছে অসহনীয় লাগে। বোকা মানুষ বলেই তিনি মনের ভাব গোপন রাখেন না–সরাসরি বলেন। পানের পিক ফেলে গম্ভীর গলায় বলেন, একটা কিছু ব্যবস্থাতো নেওয়া দরকার। আর কত দিন। আমার ছেলেপুলে বড় হচ্ছে।
তারপরেও সুরাইয়া তার ভাবীকে খুব পছন্দ করে কারণ ফাতেমারও ধারণা ইমনের বাবা বেঁচে আছে। কোন একদিন ফিরে আসবে।
সেই কোন একদিনটা কবে? সেটা ফাতেমা জানেন না। সুরাইয়াও জানে না। সুরাইয়ার কেন জানি মনে হয় লোকটা ফিরবে গভীর রাতে। হয়ত ৰূপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যেই ভিজতে ভিজতে উপস্থিত হবে। সুরাইয়া দরজা খুলে দেবে। সে ঢুকবে খুব সহজ ভাবে। যে কোন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকা হচ্ছে লোকটার স্বভাব। সে তার স্বভাব মত বলবে, দেখি, একটা তোয়ালে দেখি। মাথাটা ভিজে গেছে। সুরাইয়া তোয়ালে এগিয়ে দেবে। মানুষটা মাথা মুছতে মুছতে বলবে, তুমি কেমন আছ?
সে বলবে, ভাল।
এত রোগা লাগছে কেন, শরীর খারাপ?
সেও সহজ ভাবেই বলবে, না শরীর ঠিকই আছে। যে যেমন তার সঙ্গে সে রকম আচরণই করতে হয়। মানুষটা এক পর্যায়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে বলবে, ইমনের পাশে শুয়ে আছে। এই ছোট মেয়েটা কে?
ওর নাম সুপ্ৰভা।
সুপ্ৰভা কে?
সুপ্ৰভা হল ইমনের ছোট বোন।
বল কি? সুন্দর হয়েছে।তো!
হ্যাঁ সুন্দর হয়েছে। ওকে ডেকে তুলব, কোলে নেবে?
না থাক, ঘুম ভাঙ্গিয়ে দরকার নেই। ইমানতো দেখি অনেক বড় হয়েছে।
বড়তো হবেই। তুমি কি ভেবেছিলে যে রকম রেখে গেছ ফিরে এসে সে রকম দেখবো?
মানুষটা কথা ঘুরাবার জন্যে বলবে, ঠাণ্ড লেগে গেছে, চা খাওয়াতে পারবে।
অবশ্যই পারব। কেন পারব না। তুমি ভাত খাবে না?
হ্যাঁ খাব। ভাতও খাব। গোসল করতে হবে, সাবান দাওতো।
ভাত খাবার আগেই চা খাবে, নাকি ভাত খাবার পর চা খাবে?
চা খেয়ে গোসল খানায় ঢুকব। আচ্ছা, এই বাড়িটা কার?
বাড়িতো বেশ বড়।
মানুষটা চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকবে–সুরাইয়া যাবে চা বানাতে। শুধু চা বানালে হবে না। ভাত চড়াতে হবে। গরম ভাত। ভাতে এক চামচ ঘি, ডিম ভাজা। ডিম ভাজার সঙ্গে শুকনো মরিচ ভাজা। নতুন আলু ডোবা তেলে মচমচে করে ভাজা! মানুষটার খুব প্রিয় খাবার।
সুরাইয়া রোজ রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে কাল্পনিক কথোপকথন চালায়। একেক রাতের কথা বার্তা হয় একেক রকম। রাতের এই কথোপকথন অংশটা তার বড় ভাল লাগে।
ইমন অন্ধকারে সিঁড়িঘরের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। জায়গাটা বিশ্রী রকমের অন্ধকার, সেই কারণে তার ভয় লাগছে। আবার অন্ধকার থেকে বারান্দায় আলোতে আসতে পারছে না। সে পেনসিল হারিয়ে ফেলেছে। স্কুলের ব্যাগ গুছাতে গিয়ে ধরা পড়েছে পেনসিল নেই। এই দুঃসংবাদ মাকে না দিয়ে উপায় নেই। সে মাকে বলল।
সুরাইয়া ধমক ধামক কিছুই দিল না। শান্তগলায় বলল, যেখান থেকে পার পেনসিল খুঁজে আন। পেনসিল না। এনে আজ ঘুমুতে পারবে না।
ঘন্টা খানিক আগে সে মার সরে উঁকি দিয়েছিল। সুরাইয়া তাকে দেখেই বলল, পেনসিল পেয়েছ?