মিতুর বাবা হতভম্ব হয়ে বলবেন, কি বললি?
যা বলেছি তুমি শুনেছ।
তোর কি মাথাটা খারাপ?
মিতু আগের চেয়েও শান্ত গলায় বলবে, বাবা আমার মাথা খারাপ না। তুমি ব্যবস্থা করে দাও।
সেই গল্প যথাসময়ে বলা হবে। আপাতত আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইমন তার ছোট চাচার কোলে। সে চাচার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে আছে। নিঃশব্দে কাদছে। ফিরোজ বলছে–কেঁদে তুই আমার ঘাড় ভিজিয়ে ফেলছিস। তোর হয়েছেটা কি বলতো? পনেরো দিন পর এসেছি, কোথায় গল্প গুজব করবি–এ রকম করলে আর আসব না। দোতালা থেকে নিচে ফেলে দেব। দিলাম ফেলে দিলাম। এক মিনিটের মধ্যে যদি হাসির শব্দ না শুনি তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি ফেলে দেব!
ইমন হাসতে না পারলেও হাসির মত শব্দ করল। ছোট চাচার একটু মাথা খারাপের মত আছে। সত্যি সত্যি ফেলে দিতে পারে।
সুরাইয়ার জ্বর আরো বেড়েছে। জ্বরের আঁচে মুখ লালচে হয়ে আছে। চোখ জুল জ্বল করছে। ফিরোজ বসেছে তার সামনে একটা চেয়ারে। ফিরোজ বলল, ভাবী কেমন আছেন?
সুরাইয়া বলল, ভাল। খারাপ থাকিব কেন? খারাপ থাকার মত নতুন কিছুতো হয়নি।
আপনার জ্বর কি বেশী?
জানি না। তোমার খবর বল। ব্যবসা পাতির অবস্থা কি?
অবস্থা বেশী ভাল না। খারাপই বলতে পারেন। ব্যবসা করতে ক্যাশ টাকা লাগে। ক্যাশ টাকাতো নেই।
তোমার ভাইয়ের টাকা পয়সার খোঁজ নিতে বলেছিলাম খোঁজ নিয়েছ?
ফিরোজ কিছু বলল না, চুপ করে রইল। এই প্রসঙ্গে আলাপ করতে তার ইচ্ছা করছে না। অফিসে তার ভাইয়ের টাকা পয়সা ভালই আছে। টাকাটা পেতে হলে তার মৃত্যু হয়েছে এই মর্মে প্রমাণ সহ কাগজ পত্র দিতে হবে। ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে এ জাতীয় কোন কাগজ তার কাছে নেই। একটা মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে। এই পর্যন্তই। তার আর কোন খোঁজ নেই।
ভাবী, ইমনের পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?
জানি না।
সুপ্ৰভাতো দেখতে খুব সুন্দর হচ্ছে।
ও সুন্দর হলেই কি আর অসুন্দর হলেই কি? তুমি কি এখনো মেসেই থাক?
জ্বি।
চিরজীবন কি মেসেই থাকবে? ঘর বাড়ি করবে না, বিয়ে টিয়ে করবে না।
ব্যবসার অবস্থা ভাবী। খুবই খারাপ।
খারাপ হলে কি আর করবে। মেসে মেসে জীবন কাটিয়ে দাও।
ফিরোজ একটু ঝুকে এসে বলল, ভাবী আপনার কাছে আমি একটা আব্দার নিয়ে এসেছি।
সুরাইয়া ভুরু কুচকে বলল, কি আব্দার?
মার শরীর খুব খারাপ, প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। মনে হয়। বাঁচবেন না। আপনাকে খুব দেখতে চাচ্ছেন।
আমাকে দেখে কি হবে?
মনে হয়ত শান্তি পাবেন।
আমাকে দেখে শান্তি পাবার কিছু নেই। আমি কোন শান্তি-বড়ি না।
ভাবী, এই ভাবে কথা বলবেন না। আপনি আমার সঙ্গে চলেন। সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসি। দীর্ঘ দিন একটা জায়গায় পড়ে আছেন, ঢাকার বাইরে গেলে ভাল লাগবে।
আমার ভাল লাগা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
ভাবী, আমি হাত জোড় করছি।
সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, কথায় কথায় হাত জোড় করবে না। এইসব নাটক আমার ভাল লাগে না। আমি কোথাও যাব না।
তাহলে একটা কাজ করি, ইমনকে নিয়ে যাই?
না, ওকে আমি একা কোথাও পাঠাব না?
একা কোথায় ভাবী। আমিতো সঙ্গে যাচ্ছি। নিয়ে যাব, একটা দিন থাকব। তারপর চলে আসব।
না।
অনেক দিনতো হয়ে গেল ভাবী এখন একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করা উচিত না?
আমি স্বাভাবিকই আছি। এরচে বেশী স্বাভাবিক হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ফিরোজ, তুমি এখন যাও। শরীর ভাল লাগছে না–কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
আমি যাব বৃহস্পতিবার দুপুরে। সকালবেলা এসে একবার খোঁজ নিয়ে যাব?
কি খোঁজ নিয়ে যাবে?
যদি আপনি যান আমার সঙ্গে, কিংবা ইমনকে দেন।
একবারতো না বলেছি–তারপরেও চাপ দিচ্ছ কেন?
চাপ দিচ্ছি না ভাবী, অনুরোধ করছি। মার শরীর খুবই খারাপ। বাঁচবেন না। ইমনের জন্যে খুব অস্থির। ভাবী আজ উঠি, বৃহস্পতিবার সকালে আসব। যাওয়ার আগে দেখা করার জন্যে আসব। সুপ্ৰভা কি ঘুমুচ্ছে?
হ্যাঁ।
ওকে দিন একটু কোলে নিয়ে আদর করি।
কোলে নিয়ে আদর করতে হবে না। ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ঘুম ভাঙ্গলে বিশ্ৰী করে কাঁদে। অসহ্য লাগে।
সুপ্রভার কান্না শুধু না সুরাইয়ার সব কিছুই অসহ্য লাগে। ইমন যখন পড়ার টেবিলে বসে গুনগুন করে সেই গুনগুন কিছুক্ষণ শুনলেই অসহ্য লাগে। আবার সে যখন নিঃশব্দে পড়ে তখন চারদিকের নৈশব্দও অসহ্য লাগে। সবচে বেশী অসহ্য লাগে তার বড় ভাই জামিলুর রহমানকে।
জামিলুর রহমান মাঝে মধ্যে বোনের ঘরে ঢুকেন। নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেন। দুএকটা কথা শোনার পরই সুরাইয়ার মাথা ধরে যায়। সুরাইয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে ভাইজান প্ৰচণ্ড মাথা ধরেছে। তিনি তারপরেও বসে থাকেন। এক প্ৰসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে যান এবং কথা বলতেই থাকেন। বলতেই থাকেন।
তারপর সুরাইয়া তুই আছিস কেমন বল।
ভাল।
দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা একটা ঘরের ভেতর থাকিস। এর নাম ভাল থাকা? তোরতো পাগল হতে বেশী বাকি নাই।
পাগল আমি হব না ভাইজান, পাগল হলে আগেই হতাম। আগে যখন হই নাই এখনো হব না। আশে পাশের সবাইকে পাগল বানাব, কিন্তু নিজে পাগল হব না।
এইত একটা কথার মত কথা বলেছিস। নিজে ভাল থাকিবি। নিজের ভাল থাকাটাই জরুরী। অন্যের যা ইচ্ছা হোক নিজে ঠিক থাকলে জগৎ ঠিক। শুনে ভাল লাগল। একটা ঘটনা ঘটলে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে হবে না-কি? দুর্ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে না? সব সময় ঘটে।
ভাইজান, আমার খুবই মাথা ধরেছে।
দিন রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে থাকলে মাথা ধরবে না? মাথা ধরবেই।–আমার কথা শোন, মাথা থেকে সব কিছু বাদ দে—আয় আমরা তোর জীবন নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা কবি।