ভাল।
বড় মামার বাড়িতে চলে যাচ্ছিস তাহলে?
হুঁ।
গুড়। যাবার সময় কাঁদবি নাতো?
ভেরী গুড। বোকা ছেলেরাই কাঁদে–বুদ্ধিমানরা কাঁদে না। তুই বোকা না বুদ্ধিমান?
জানি না।
আয় পরীক্ষা করে দেখি–বোকা না, বুদ্ধিমান। কোলে এসে বোস। আমি তোর চুলে বিলি কেটে কেটে আদর করব। তখন যদি কেঁদে ফেলিস তখন বুঝব তুই বোকা। আর না কেঁদে থাকতে পারলে বুদ্ধিমান।
ইমন গুটিসুটি মেরে তার চাচার কোলে বসে আছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকানোর, কোন লাভ হচ্ছে না। চোখ ভর্তি করে পানি আসছে সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে ফেলছে। ছোট চাচার কাছে সে বোকা প্রমাণিত হচ্ছে এই দুঃখবোধেও সে আক্রান্ত তবে সে জানে না-ছোট চাচাও তার মতই বোকা। ছোট চাচার চোখ ও ভিজে উঠছে। পানি জমতে শুরু করেছে।
হার্ড নাট!
হুঁ।
যেখানেই থাকিস, যে ভাবেই থাকিস—ভাল থাকবি।
আচ্ছা।
কোন কিছু নিয়েই মন খারাপ করবি না।
আচ্ছা।
গল্প শুনবি?
হুঁ।
একদেশে ছিল এক ব্যাঙ। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ বেচারার সর্দি লেগে গেল। সর্দি এবং কফ। সারাদিন নাক ঝাড়ে আর খ্যক খ্যক করে কাশে। ব্যাঙের স্ত্রী বলল, ওগো ডাক্তারের কাছে যাও। তোমার কাশির শব্দে বাচ্চারা ঘুমুতে পারছে না। ব্যাঙ বলল, ডাক্তারের কাছে যে যাব ভিজিটের টাকা লাগবে না? তার স্ত্রী বলল, আধুলীটা নিয়ে যাও। ব্যাঙ বলল, আধুলীটাই আমাদের শেষ সম্বল সেটা নিয়ে যাব?
হ্যাঁ যাও। শরীরটাতো আগে দেখবে। টাকা গেলে টাকা পাওয়া যায়। শরীর গেলে কি আর পাওয়া যায়?
ব্যাঙ বলল, বউ কথাটাতো ভালই বলেছ। আচ্ছা যাই ডাক্তারকে বরং দেখিয়েই আসি।
ব্যাঙের স্ত্রী বলল, ব্লাড প্রেসারটাও একটু চেক করিও। আমার ধারণা তোমার প্রেসারও বেড়েছে। কাল রাতে বৃষ্টির সময় তুমি যখন ডাকছিলে তখন তোমার গলা কেমন যেন অন্য রকম শুনাচ্ছিল।
ছোট চাচা দম নেবার জন্যে থামতেই ইমন বলল, বাবা কি আর ফিরে আসবে না। চাচা?
বুঝতে পারছি না। ধরে নে ফিরে আসবে না। তাহলে কষ্ট কম পাবি। ফিরে আসবে ভেবে অপেক্ষা করছিস-মানুষটা ফিরছে না-কষ্ট বেশী না?
হুঁ।
তোর মা সারাক্ষণ ভাবছে—এই বুঝি মানুষটা ফিরল। রাতে ঘুমায় না। জেগে থাকে, গোটে সামান্য শব্দ হলে ছুটে আসে—এই অবস্থাটাতো ভয়ংকর।
সুপ্ৰভা খুব কাঁদছে। সুরাইয়া মেয়ের কান্না থামানোর কোন চেষ্টা করছে। না। কাদুক। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় নিজেই থেমে যাবে। সে যখন কাঁদে তখনতো কেউ তার কান্না থামাতে আসে না। সে কোন যাবে? তার এত কি দায় পড়েছে?
পৌষ মাস প্রচণ্ড শীত পড়েছে
পৌষ মাস। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। শীতের সঙ্গে কুয়াশা। ইমন বসে আছে তার বড় মামার বাড়ির দোতলার বারান্দায়। সে অবাক হয়ে দেখছে কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। একটু দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। বাড়ির সামনে কাঁঠাল গাছটাকে মনে হচ্ছে ছোট একটা পাহাড়। তার ছোট চাচা বলেছিলেনকুয়াশা আসলে মেঘ। আকাশের মেঘ যখন মাটিতে নামে তাকে বলে কুয়াশা। ইমনের খুব অদ্ভুত লাগছে এই ভেবে যে সে মেঘের ভেতর বসে আছে। আজ ছুটির দিন, তার বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকার কথা না। ছুটির দিনের সকাল বেলায় এই বাড়িতে নানান ধরণের খেলা হয়। টোকন আর শোভন টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলে। টোকনের খুবই কাদুনে স্বভাব। কিছু হতেই কান্না শুরু করে। আর শোভন মারামারিতে ওস্তাদ। হুট করে মারামারি শুরু হয়ে যায়। শোভন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ধমাধ্যম ভাইকে মারে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কেউ কখনো নালিশ করে না। মারামারি এবং কান্নাকাটি কিছুক্ষণের মধ্যে থেমে যায়। আবার খেলা শুরু হয়। মিতু একা একা রান্না বাটিখেলে। ক্রিকেট খেলায় তাকে নেয়া হয় না, মিতুও রান্নাবাটি খেলায় তাকে নেয় না। একদিন শুধু বলেছিল, এই তুই চাকর হবি? তুই চাকর হলে খেলতে নেব। যা বাজার করে নিয়ে আয়। মনে করে কাঁচা মরিচ, আনবি। আর খবর্দার পয়সা সরাবি না।
ইমনের খেলতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু চাকর হওয়াটা মেনে নিতে পারছিল না বলে খেলে নি। তবে না খেললেও সে বেশির ভাগ সময় আশে পাশে ঘুর ঘুর করে।
আজি ইমন এখনো নিচে নামছে না। কারণ নিচে নামিয়ে নেয়ার জন্যে মিতু আসেনি। বড় মামার বাড়ির দোতলার সিঁড়ি পুরোপুরি শেষ হয় নি। রেলিং দেয়া বাকি। এ রকম সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে ইমনের অসম্ভব ভয় লাগে। মিতু বয়সে তার সমান হলেও, ঠিক সমান ও না, পাঁচ দিনের বড়। ভয়ংকর সাহসী। একবার সে চোখ বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল। মিতু শুধু যে চোখ বন্ধ করে সিড়ি দিয়ে উঠতে পারে তাই না। তিন তলার ছাদে পা ঝুলিয়ে বসতেও পারে। সেই ছাদেরও রেলিং নেই। ইমনের বড় মামা ছাদে রেলিং দেবেন না— শুধু শুধু বাজে খরচ। ইমনের ধারণা বাজে খরচ হলেও রেলিং দেয়া উচিত। তা না হলে কোন একদিন মিতু ছাদ থেকে পড়ে যাবে। ইমনের ধারণা দোতলার সিঁড়িতেও রেলিং দেয়া উচিত। রেলিং দেয়া না হলে সে নিজেই কোন একদিন পড়ে যাবে।
ইমন!
ইমন চমকে উঠে দাঁড়াল। মা ডাকছেন। আগে মা ডাকলেই আনন্দ হত, এখন হয় না। মার ডাকা মানেই কিছু একটা নিয়ে ধমকা ধমকি হবে। ধমক খাবার মত কিছু অবশ্যি সে করেনি। সকালে বই নিয়ে বসে অনেকক্ষণ পড়েছে। মা যখন বললেন, যথেষ্ট ঘ্যানঘ্যােনানি হয়েছে এখন যাও। তখনি শুধু সে উঠে এসেছে।