বেড়াতে গেছেন? কোথায় বেড়াতে গেছেন?
ইণ্ডিয়াতে— মধ্যপ্রদেশে।
মিস ফিক করে হেসে ফেলে বললেন, মধ্যপ্রদেশে? এত জায়গা থাকতে মধ্যপ্রদেশে কেন?
মধ্যপ্রদেশে অনেক বড় বড় জঙ্গল। বাবা জঙ্গল দেখতে গেছেন।
ও আচ্ছা, খুব ভাল কথা। উনি কি তোমার মার সঙ্গে রাগ করে চলে গেছেন?
জ্বি-না। বাবা কারোর সঙ্গে রাগ করে না।
তোমার মা, তিনি রাগ করেন?
জ্বি করেন।
কার সঙ্গে রাগ করেন?
বুয়ার সঙ্গে করেন, ছোট চাচার সঙ্গে করেন। মা রোগাতো এইজন্যে মার অনেক রাগ। রোগা মানুষদের খুব রাগ থাকে।
রোগা মানুষদের খুব রাগ থাকে এটা কে বলল?
ছোট চাচা বলেছেন। উনিও রোগা এই জন্যে উনারও খুব রাগ।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।
ইমন মার রাগের জন্যে খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। টিভিতে কার্টুন দেখার সময় সাউণ্ড খুব কমিয়ে দেয়। মা খুব যখন হৈ চৈ করতে থাকেন তখন সে টিভির সাউণ্ড পুরোপুরি অফ করে দেয়। সাউন্ড ছাড়া কার্টুন দেখতে তার খারাপ লাগে না। সাউন্ডগুলি ভেবে নেয়। কোন দৃশ্যে কি রকম সাউন্ড হবে এখন সে মোটামুটি জানে।
মা যখন অন্যদের উপর রাগ করে তখন ইমনের তেমন খারাপ লাগে না, কিন্তু যখন সুপ্রভার উপর রাগ করেন তখন খুব খারাপ লাগে, কাঁদতে ইচ্ছা করে। সুপ্রভার উপর মা প্রায়ই রাগ করেন।
সুপ্ৰভা কেঁদে গলা ফাটিয়ে ফেলছে–মা ফিরে তাকাচ্ছেন না। বুয়া এসে যদি বলে—আপু কানতাছে। তখন মা তীব্রগলায় বলেন, কাঁদছে। কাদুক তুমি তোমার কাজ কর। কাজ ফেলে চলে এসেছ কেন? ছোট চাচা এক সময় উঠে এসে বলেন, ভাবী বাচ্চাটার কি হয়েছে? মা তখন বিরক্ত গলায় বলেন, জানি না কি হয়েছে। ওর মনের খবর আমি জানব কি ভাবে?
কাঁদতে কাঁদতেতো গলা ভেঙ্গে ফেলছে।
গলা ভেঙ্গে মরুক।
ভাবী এইসব কি কথা বলছেন?
আমার যা মনে আসছে বলছি, তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে?
হ্যাঁ, অসুবিধা হচ্ছে। বাচ্চাটা পেটের ক্ষিধেয় কাঁদছে, আপনি ফিরে তাকাচ্ছেন না, এটা কেমন কথা।
তুমি এমন চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলছি কেন? তোমার ভাইতো কখনো মুখ শক্ত করে এমন ভাবে কথা বলেনি।
চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলার জন্যে আমি সরি। ভাবী শুনুন, ফর গডস সেক, স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার চেষ্টা করুন।
ভাইজানের জন্যে কষ্ট শুধু আপনি একা পাচ্ছেন আর কেউ পাচ্ছে না। এটা আপনি কি করে ভাবছেন? কষ্ট পাচ্ছেন ভাল কথা-কিন্তু একটা দুধের শিশুকে কষ্ট দেবেন। কেন? তার অপরাধটা কোথায়?
খবৰ্দার, তুমি আমার সঙ্গে চোখ লাল করে কথা বলবে না।
ভাবী আমি চোখ লাল করে কথা বলছি না, আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি— ওকে দুধ খেতে দিন।
নাটক করবে না। নাটক আমার ভাল লাগে না—একে তোমরা নিয়ে কোথাও পালক দিয়ে দাও।
আচ্ছা ভাবী ঠিক আছে, তাই করব। আপাতত আপনি একে সামলান।
এই পর্যায়ে মা সুপ্ৰভাকে কোলে নেন। সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না থেমে যায়। তখন কান্না পেয়ে যায় ইমনের। সে ছোট চাচার ঘরে ঢুকে কাঁদতে শুরু করে। ছোট চাচা গম্ভীর গলায় বলেন, ইমন তোকে কেউ মেরেছে?
ইমন ফোঁপাতে ফোপাতে বলে, না। মারে নি।
তোকে কেউ বকা দিয়েছে?
না।
জানি না। পুরুষ মানুষ কি কাঁদতে পারে?
না।
ফোঁস ফোঁস করতে পারে?
না।
হেঁচকি তুলতে পারে?
না।
তুইতো একই সঙ্গে কাঁদছিস, ফোঁস ফোঁস করছিস এবং হেঁচাকি তুলছিস। তিনটা নিষিদ্ধ জিনিশ করছিস। চোখ মুছে কচ্ছপ নিয়ে আয়—একটা মজা দেখাব।
কি মজা?
আগে নিয়ে আয়, তারপর দেখবি।
ইমন কচ্ছপ নিয়ে এল। ফিরোজ কচ্ছপ দুটা উল্টা করে মেঝেতে রেখে দিল। এরা খোলসের ভেতর থেকে মাথা এবং পা বের করে সোজা হবার চেষ্টা করছে, পারছে না। ফিরোজ হৃষ্ট চিত্তে বলল, এই হচ্ছে মজা।
কি মজা?
যত চেষ্টাই করুক, এরা এখন আর সোজা হতে পারবে না। ছটফট করবে। কিন্তু পারবে না। বাইরের কোন সাহায্য লাগবে। তুই বা আমি যদি সোজা করে দি, তাহলেই সোজা হতে পারবে। মজাটা এইখানেই। মানুষেরও মাঝে মাঝে কচ্ছপের মত অবস্থা হয়। মানুষ উল্টে যায়। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করতে থাকে, ঠিক হতে পারে না। বাইরের সাহায্য ছাড়া ঠিক হওয়া তখন সম্ভব না। তোর মার এখন এই অবস্থা চলছে। সে উল্টে গেছে। ঠিক হবার জন্যে ছটফট করছে, কিন্তু পারছে না। কাজেই তোর মার উপর রাগ করেও কোন লাভ নেই। মার উপর তোর রাগ নেইতো?
না নেই।
ভেরীগুড। আরেকটা কথা–যদি কোন কারণে খুব মন খারাপ হয় তখন কচ্ছপ উল্টে দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবি–তখন দেখবি মন ভাল হয়ে যাচ্ছে।
কেন?
কেন কেন করবি না। চড় খাবি।
আচ্ছা করব না।
আজি ইমনের মন সামান্য খারাপ। বেশী না সামান্য। এই সামান্য মন খারাপ নিয়ে কচ্ছপ উল্টানো যায় না বলে সে উল্টাচ্ছে না–শশার টুকরা কেটে খেতে দিচ্ছে। এরা খাচ্ছে না। হাতে ধরে থাকলে এরা খায় না, কিন্তু পানিতে ছেড়ে দিলে মুখ বের করে কুট কুট করে খায়।
ইমন। এদিকে শুনে যাও।
ইমনের বুক ধ্বক করে উঠল। আগে মা ডাকলে আনন্দ লাগতো, এখন মা ডাকলেই বুক ধ্বক করে উঠে। ইমন কচ্ছপ দুটা বালতিতে রেখে মার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়াল। মা সুপ্রভার গায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। তিনি চোখ সরু করে তাকালেন। ইমনের বুক শির শির করতে লাগল।
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কাছে আস।
ইমন ঘরে ঢুকল।
হাত ভেজা কেন? আবার কচ্ছপ নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করছিলে? হাত ধুয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছ?
ইমন সাবান দিয়ে হাত ধোয়নি-তারপরেও ভয়ে ভয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সে জানে এই মিথ্যা মাথা নাড়ার জন্যে তার বা কাধের ফেরেশতা পাঁচটা বদি লিখেছে। ফেরেশতার নাম কেরামান কাতে।বিন। তার কাজ মানুষের খারাপ কাজগুলি লেখা এবং কোন খারাপ কাজের জন্যে কয়টা বদি হয়েছে তার হিসাব রাখা। দাদীজান তাকে বলেছেন।