হাসবো না তো কি কাঁদবো?
বিশ্বাস হচ্ছে না নিশ্চয়ই?
বিশ্বাস হবে না কেন? আগাগোড়া একটা ব্যাপারকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে যেভাবে কসরত করে চলেছে তাতে বিশ্বাস না করলে রক্ষে থাকবে! বলিহারি বাহাদুরি তোমার! খোকা পা লম্বা করে বললে, থামলে কেন, চালিয়ে যাও, নিদেনপক্ষে টেকনিকটা তো রপ্ত হবে।
ভেঁপোমি করবে না বলে দিচ্ছি। আমার কথা শেষ করতে দেওয়া তোমার ইচ্ছে নয়, ভেবেছো আমি তা বুঝি না?
ঠিক হায়, ঘাট মানছি–
যা বলছিলাম। হ্যাঁ, আমাদের বিয়েটা ছিলো সত্যিকারের প্রেমের। ও তখন এক বিদেশি ফার্মে চাকরি করছে। পাথর হাতড়ায় আর বই পত্তরের ভিতর মশগুল হয়ে থাকে। একটু দাঁড়াও, গুলিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু–
দাঁড়াতে হবে?
হ্যাঁ, তেরো বছর আগেকার কথা সেসব। আমার বয়েস তখন আঠারো, ওনার ছত্রিশ কি সাঁইত্রিশ
মানে ফরিন স্টাইলের লাভ আর কি!
যা বলো তাই। সুন্দর গাইতে পারতো ও, ক্লাসিক্যাল চর্চা করতো ও; এস্রাজও বাজাতে পারতো
হুঁ, ক্লাসিক্যাল বেজায় সুবিধে বাধা দিয়ে খোকা বললে, ঘোড়েল লোক!
শুধু তাই নয়, দুদ্দাড় করে মুখে মুখে এমন সব গল্প বানাতে পারতো যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত।
হাইজাম্প, লংজাম্প, এসব?
না ওসব নয়, তবে মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো হাত সাফাইয়ের খেলা, ম্যাজিক, এসব জানতো।
ব্রাদার আমার জাত ম্যাজিশিয়ান!
ওর মতো প্রানোচ্ছল স্পষ্ট তেজি মানুষ আমার আর চোখে পড়ে নি।
চোখে যে তুলি লাগিয়েছিলে, তা না হলে আসল ব্যাপারটাই ধরা পড়লো না কেন? সবকিছু ছিলো নিছক ভাঁড়ামি, ছুকরি পটাবার কায়দা।
হিংসে হচ্ছে বুঝি? ওই নোংরা জিনিসটার বালাই ওর ভিতরে একদম নেই। ওকে পাবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠছিলাম আমি নিজেই। তুমি বিশ্বাস করবে না খোকাবাবু, ওর এক একটা কথায় কিভাবে চলকে উঠতাম। এতো অদ্ভুত এতো সুন্দর কথা বলতো ও! ওর মুখের কথা শুনে শুনে আশ মিটতো না আমার!
দেদার কোটেশান ঝাড়তো নিশ্চয়ই?
কক্ষোনো না—
বলছো কি, তাহলে দৃষ্টিপাত পড়ে নি বলতে চাও?
ওকে তুমি চেনোই না—
বাধা দিয়ে খোকা বললে, ও ও না করে সরাসরি নাম ধরেই বলো না কেন! আধুনিকরা তো তাই করে। খোকাবাবু খোকাবাবু ডাকটাও ছাড়তে হবে, ওটা গালাগালির মতো শোনায়
নীলাভাবীর চোখজোড়া স্বপ্নালু হয়ে এলো। বললে, আমি আর এখন আধুনিকাদের দলে পড়ি না। সত্যিই কি ছিলো মানুষটা, আর আজ কি দশা হয়েছে। কিছুদিন থেকেই চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না, বড় স্বার্থপর নিচ মনে হচ্ছিলো নিজেকে: আমি জানি মানুষটার ওই ধসে যাওয়া, হুমড়ি খেয়ে পড়া ইতশার জন্যে আমিই দায়ী। ওর সবকিছু আমিই সাবাড় করে দিয়েছি। ফতুর করে দিয়েছি ওকে। আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সেই খাড়া একরোখা মানুষটার; যেন একটা পুরানো থলে, ভিতরটা শূন্য, ফেঁসে যাওয়া, পড়ে আছে একপাশে–
চোখের কোণে পানি চিকচিক করে উঠলো নীলাভাবীর। রানী অশ্রুমতি সহসা এমন উতরোল হয়ে উঠলো কেন, খোকা ভাবতে চেষ্টা করে। আর এতো কিছু থাকতে থলের উপমাটাই বা ঠোঁটে এলো কেন, তারও হদিস পায় না সে; ফেঁসে যাওয়া, পড়ে আছে একপাশে, কুচ্ছিত শোনায়।
মানুষটার দিকে তাকালে কষ্টে বুক ভেঙে যায়। অথচ ইচ্ছে করলে, সময় থাকতে সতর্ক হলে, আমি ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। প্রথম থেকেই ওকে আনতাবড়ি খরচ করার ব্যাপারে সাবধানী হওয়া উচিত ছিলো। তা না করে দুহাতে কেবল উড়িয়েছি ওকে বাপ-দাদার জমিদারির মতো। বেমালুম ফুকে দিয়েছি সব। কোনোদিন টেরও পেলো না দিনের পর দিন আমার বেহিসেবি হাতে খুচরো পয়সার মতো কিভাবে ফৌত হয়ে যাচেছ। এখন যদি বলি, একটা গল্প শোনাও, সাধ্যমতো চেষ্টা করবে, কিন্তু পারবে না, বলবে আজকাল আর ওসব মাথায় আসে না, মাথার ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় সব; আসলে বুড়িয়ে গিয়েছি, বয়েস তো আর কম হয় নি। বললে কি হয়, আমি খুব ভালো করেই জানি ওটা একটা অজুহাত মাত্র। ওর মন এখনো যথেষ্ট সতেজ, তোমার চেয়েও। এস্রাজের অভ্যেসটা টেনেটুনে কোনোরকমে বজায় রেখেছিলো অনেকদিন পর্যন্ত, কিন্তু বাগড়া পড়লো সেখানেও। একটা গৎ ধরার পর কাছে গিয়ে বসতাম, বলতাম নতুন কিছু একটা বাজিয়ে শোনাতে; কখনো ভেবে দেখিনি নতুন কিছু ও শোনাবে কোত্থেকে! যতটুকু অবসর পায় তার সবটুকুই থাকে আমার দখলে, আর এই লোভেই আমি সংসারের মোহ গায়ে মাখিনি, মনের আনন্দে সংসারের দখলদারি ঠেলে দিয়েছিলাম আরেক দিকে। অবসর সময়ে আমি ওকে পানদোক্তার মতো মুঠোর ভিতর পুরে রাখি, আমার হাতের তালুর চাপে ও ঘেমে ওঠে, কিছু বলতে পারে না কখনো মুখ ফুটে, আমার খুশিতেই ওর আনন্দ, অতএব বলবেই বা কেন। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বেচে এলো একদিন এস্রাজটা। বললে, ভালোই হলো, ওই একঘেঁয়ে কো কা আর কাহাতক ভালো লাগে, নতুন কিছু হাতেই আসে না। ল্যাঠা চুকলো যা হোক। সেদিন সারারাত আমি বালিশে মুখ গুঁজে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিলাম। আর কিছু রইলো না মানুষটার, শুধু আমার জন্যে, কেবল আমার জন্যে–
অঝোরে কাঁদতে লাগলো নীলাভাবী, সে কান্না কিছুতেই আর থামতে। চায় না।
এই হাস্যকর নাটুকেপনার কি সত্যি কোনো মানে হয়?
খোকা মনে মনে খতিয়ে দেখলে, এই মুহূর্তে তার কিছুই করণীয় নেই। কোলের দিকে মুখ নিচু করে আকাশ ভেঙে কেঁদে চলেছে নীলাভাবী; কখন যে কার ভিতর কোন রোগ চাড়া দেয় বোঝা দুঃসাধ্য। জাপটে ধরে একটা চুমু খেলেও এখন ভাবান্তর হবে না; কান্না ছাড়া পৃথিবীতে এই মুহূর্তে আর কিছু ভালো নেই, নীলাভাবীর ভাবখানা এখন এমন। বন্ধুদের কেউ হলে নির্ঘাত চুমু খেতো এবং আদর করতো। ইয়াসিন তো খোলাখুলি বলেই অনেক সময়, বুড়ো বয়েসের আগে মেয়েমানুষকে যে শ্রদ্ধা করে কিংবা ধর্মকর্ম নিয়ে চাগিয়ে ওঠে সে ব্যাটা এক রামপঠা, তাকে লৌড়ানো দরকার; মানুষের বুড়ো হয়ে না জন্মানোর পিছনে উপরওয়ালার বহুৎ খেয়ালখুশি কাজ করে।