সিগ্রেট আছে।
আছে তো টানছো না কেন?
দরকার মনে করি নি এতোক্ষণ! কথাটা শেষ করেই যন্ত্রচালিতের মতো সিগ্রেট ধরায় খোকা। ফুল স্পিডে পাখা চলছিলো বলে তেরোটা কাঠি খরচ হলো দেশলাইয়ের।
কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শুরু করলে নীলাভাবী, তোমার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক, আর কেনই বা তা, খুলে বলতে হবে আজ তোমাকে। তোমার মাথার ভিতরে বহুৎ আবর্জনা জমে আছে, সাফ করা দরকার–
বাধা দিয়ে খোকা বললে, বুঝেছি, আজ শালার গলা পানিতে না চুবিয়ে তুমি ছাড়বে না, রয়ে রয়ে স্রেফ প্যাচের ভিতরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যাচ্ছেতাই! তোমার যা খুশি অনর্গল বকে যেতে থাকো, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু কোনো জবাব পাবে না।
জবাব দেয়ার মুরোদ থাকলে তো জবাব দেবে! আমি জানি এসবের কোনো একটারও জবাব তোমার নিজের জানা নেই। নীলাভাবী কোমর বেঁধে শুরু করলে এবার, সত্যি, এক একটা আকস্মিক ঘটনায় এমনভাবে চোখ খুলে যায়, ভাগ্যিশ তোমার দেখা পেয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো, তা না হলে যথেষ্ট বিপদ ছিলো। আমার নিজেকে নিয়ে। তোমার হয়তো কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস হবে না, নিজেকে নিয়ে নিজের কাছে এখন কোনো সমস্যাই নেই আমার। এসব সহজে বিশ্বাস করতে কেউ বড় একটা চায়ও না। কেন চাইবে, অকারণে রাজ্যির যতো জঞ্জাল জড়ো করাটা যখন মানুষের জন্মগত দোষ, সেখানে এটাই তো স্বাভাবিক। আমি খুব ভালো করেই জানি, নিজের সম্পর্কে আমার ধারণাগুলো কড়ায়-ক্রান্তিতে নির্ভুল। নিজেকে জটিল অঙ্কের শামিল করে ফল মেলাতে না পারার মতো মর্মান্তিক আর কিছু নেই; ঘৃণা করি আমি এইসব বানোয়াট জটিলতাকে। দৈব-দুর্বিপাকেও যদি আমাকে তার ধারালো খপ্পরে পড়তে হয়, আমি গা বাঁচিয়ে, নিজের শরীরে একটি আঁচড়ও না লাগিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করবো। বুঝি না, সংসারের সবাই সবকিছুকে সহজে নিতে পারে না কেন। সহজভাবে নিতে না পারলেই সবকিছু দুর্ভার মনে হতে থাকে—
এই পর্যন্ত এসে থামলো নীলাভাবী। যতদূর আন্দাজ করতে পারে। খোকা তাতে তার মনে হয় এটা একটা ভূমিকা মাত্র। নীলাভাবীর চোখমুখ চলকে উঠছে, একটা কিছু প্রবলভাবে তোলপাড় করে চলেছে। ভিতরে ভিতরে; অসংখ্য পলকাটা একটা নীলকান্ত মণির মতোই রহস্যময় দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে অন্তস্তল থেকে।
খোকা, তুমি জানো না বা জানো, আজ মুখ ফুটে একটা কথা তোমার কাছে অকপটে স্বীকার করবো, সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি–
একথায় বড় বড় চোখে তাকালো খোকা; তার ধারণা ছিলো একমাত্র বইপত্রেই এইসব কথা স্থান পায়, কিংবা যখন মুদ্রণপ্রমাদ ঘটে তখন ব্লাউসের বোতাম খুলতে ভালোবাসির স্থলে ওই কথা ছাপা হয়।
কবে থেকে জানো? মনে করো না একেবারে সেই প্রথমদিন থেকে। প্রথম যেদিন তুমি তোমার রাজীব ভাইয়ের সাথে এ বাড়িতে এলে, তখন তো আমি তোমাকে দেখে প্রায় হেসেই ফেলেছিলাম। এককালে ওনার কোকেন খাওয়ার মতো বড়শিতে মাছ ধরারও বেজায় নেশা ছিলো। আমার মনে হলো নেশাটা আবার চাগান দিয়েছে, সঙ্গে তাই অমন একটা লিকলিকে ছিপ–
বাধা দিলে খোকা। বললে, ছিপই-তো! ছিপ না হলে কি আর মাছ গাঁথে?
নীলাভাবী গায়ে মাখে না। স্বপ্নের ভিতর ঢিল খেয়ে হঠাৎ ঝটপট উড়ে যাওয়া পায়রার ঝাঁক আবার এসে বসে। নীলাভাবী বলতে থাকে, যেদিন তুমি প্রথম অকপটে বললে, আমার জন্যে তোমার মন কাঁদে, আমাকে না দেখে তুমি থাকতে পারো না, সেদিন আমার মনে গভীর একটা দাগ কেটে দিলে তুমি। মুগ্ধ হয়ে গেলাম তোমার স্বীকারোক্তিতে; যেন অনেকদিন থেকেই এমন একটা কিছুর জন্যে ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করছিলাম। এতো দ্রুত ঘটে গেল সবকিছু! এক সময় আমি জিগ্যেস করলাম নিজেকে, এটা কি আমার পক্ষে ঠিক হচেছ? আমার আছে স্বামীর দায়ভাগ। নিজেকে অবিশ্বাসিনী স্ত্রী ভাবতেও ঘৃণা হয় আমার। পরস্পরকে ভালোবেসেই আমরা বিয়ে করেছিলাম, এখনো ভাবতে পারি না তাতে চিড় খেয়েছে। তোমাকে নিয়ে এইভাবে আমি অনেক ভাবলাম। যতোই ভাবি, তুমি আমাকে নেশার মতো পেয়ে বসতে থাকো, সে এক নিদারুণ করুণ অবস্থা আমার। শেষে জিদ ধরলাম নিজের সঙ্গে, একান্তই যদি তোমার উপরে আমার একটু টান পড়ে থাকে, কি এমন অপরাধ তাতে! আর আগুন যখন আমার নিজেরই হাতে, গোটা সংসার ছারখার হবার ভয়টা কোথায়! নিজের হাতে, মানে, নিজের আয়ত্তে। সুবিধে এখানে এই, তোমাকে আমার এমন কিছুও দিতে হবে না যাতে করে দ্বিতীয় কারো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিছুই নেই আমার দেয়ার মতো, পক্ষান্তরে এমন কিছু ও তুমি আমাকে কোনোদিন দিতে পারবে না যাতে করে আমার স্বামীর এই বয়েসে প্রাণান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার সম্ভাবনা দেখা দেবে। আমাকে দেয়ার মতো তোমার কিছুই নেই একথা কেন বলছি তুমি নিশ্চয়ই তা বুঝবে…
একটু থেমে, ঢোক গিলে নীলাভাবী বললে, অনেক কিছুই আছে, কিন্তু নিজের যোগ্যতা বিচার করলে দেখা যায়, যাকে বলে সত্যিকারের নেবার যোগ্যতা, এখন আর তা আমার নেই। এই যোগ্যতার মাপকাঠিতে ফেলে নিজেকে যাচাই করে দেখতে পেরেছিলাম বলেই সবকিছুর এমন সহজ মীমাংসা সম্ভব হয়েছিলো। মনে করে বসো না আবার স্রেফ বিনয়ের ব্যভিচার হচ্ছে। অনেক রকমে ঘাঁটাঘাঁটি ওলটপালট করে দেখলাম, এক ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেবার নেই আমার। ক্ষণিকের তাড়নায় কিংবা ভুলক্রমে যা কিছু ঘটে ঘটুক, আমি তাকে হিসেবের মধ্যেই ফেলি না। অসম্ভব দুর্বলচিত্ত ছেলে তুমি। কোনো কিছুই তোমার সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাধীন নয়। ইচ্ছে করলে লুট করতে পারতাম; ফতুর করে ছেড়ে দিতে পারতাম। কিন্তু কি লাভ, কি লাভ হতো তাতে? তোমার কিংবা আমার? লুটের মাল দিয়ে নিজেকে সাজাতে চাই না, ঐশ্বর্য মনে করি উপহারকে। এসব কথা হেঁয়ালির মতো মনে হতে পারে তোমার, এটাই স্বাভাবিক। যে-কোনো একটা ব্যাপারকে উল্টোভাবে খতিয়ে দেখার মতো মনের জোর সকলের থাকে না। দুঃখে আমার ভয় নেই। জীবনে দুঃখ পেতে হয়। দুঃখের এই একটা চরিত্র, সে সুযোগ পেলে পিষে ফ্যালে বটে, শেখায়ও প্রচুর; সাহস করে, মাথা উঁচু রেখে, বুক টান করে যারা তার মুখোমুখি দাঁড়ায় তারা কেউ কখনো খালি হাতে ফেরে না। এসব কথা আর একদিন হবে। সত্যি, আমি ওর জীবনটা ফতুর করে ছেড়েছি। এখন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বুঝলে তো, তোমার রাজীব ভাইয়ের কথা বলছি। লোকে জানে ছেলেপিলে না হওয়ায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে লোকটা; আমরা নিজেরাও কতকটা ওই গাবাজি! প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছিলাম দুজনে, তল পাচ্ছিলাম না, কূল পাচ্ছিলাম না; ডুবে মরতে মরতে কোনো রকমে ডাঙায় এসে ভেড়া–মানে বিয়ে করা। তা না হলে মরেই যেতাম, কি, খুব যে কিটকিটিয়ে হাসা হচ্ছে?