ধরো–পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরে নীলাভাবী। বললে, খালি চিনি কিন্তু, ঘরে লেবু নেই–
নিকুচি করি আমি লেবুর! এবার থেকে টিকিট কেটে দেখা করতে আসবো তোমার সঙ্গে!
এতোদিন বিনা টিকিটে আসছিলে, না পাশে?
খচড়ামি রেখে খাওয়াটা সেরে এলেই খুশি হতাম!
তবে কি? নীলাভাবী একগাল হেসে বললে, তোমার জন্যে বসে আছি নাকি পেটে পাথর বেঁধে? পুরুষ মানুষের গোসল করা আর মেয়ে মানুষের খাওয়া—সময় বেশি নিলেই অখ্যাতি। পাঁচ মিনিটের বেশি কখনোই আমার লাগে না!
কথা না বাড়িয়ে গিলে এসো না বাবা!
নীলাভাবী হেসে বললে, হুবহু নকল তোমার রাজীব ভাইয়ের, কথা বলার ঢংটি পর্যন্ত!
সত্যিই বলছো খেয়ে এসেছো?
সত্যিই! তুমি তো আমার গুর নও, তোমায় ফেলে খেতে দোষ নেই–
গুরু আবার কি?
আচ্ছা আচ্ছা, সে একদিন শিখিয়ে দেওয়া যাবে–
বলো কি, শেখারও আছে আবার, গ্যাঁড়াকল তো মন্দ নয়।
শেখার আছে বৈ কি, সব ব্যাপারেই শেখার আছে। সব ব্যাপারেই রীতিমতো সুশিক্ষা দরকার, বুঝলে?
এতোক্ষণ ঠিকই বুঝছিলাম, কিন্তু ঐ যে জোর দিয়ে বুঝলে বলেই সব কাঁচিয়ে দিলে!
এক একটা ব্যাপারে এক একজনের কাছে শিক্ষা নিতে হয়। অনেক ব্যাপারে তোমার হাতেখড়ি ভালো মাস্টারের কাছে হয় নি। তরল?
তরল।
কিন্তু ফিক ফিক করে হাসিটা কেন?
সন্দেহটা কেটে গেছে এই আর কি। অনেক ব্যাপারে কথাটা এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাকে–
বুঝেছি এই জন্যেই তোমার সরেস মাথাটার এতো প্রশংসা করি সবসময়। ব্যাপারটা কি রকম হলো জানো, পানের ভিতরে চুন খয়ের সুপুরির সঙ্গে একটিপ আসল জিনিস—মানে কোকেনও চালান করে দেওয়া হলো গালে–
রাজীব ভাইয়ের বোধহয় দেদার চলে ওইসব?
আগে চলতো, এখন বদভ্যাসটা ছেড়ে গেছে।
মানে তুমি ছাড়িয়ে দিয়েছ?
কি করে বুঝলে?
ঐ যে অভ্যেস না বলে বদভ্যাস বললে!
মাঝে মাঝে তোমার বুদ্ধিটা এমন খোলতাই হয়ে যায়!
তোমার কাছে এলেই দারুণ কাজ করতে থাকে আমার বেন, তুমি হচ্ছে যাকে বলে একেবারে খাটি ব্রেন-টনিক।
নীলাভাবী হঠাৎ কেমন যেন মনমরা হয়ে যায়। চোখমুখে গাম্ভীর্য ছায়া ফেলে। নীলাভাবীর চেহারায় কোথায় একটা ধার আছে মনে হতে থাকে খোকার।
একটা কথা জিগ্যেস করবো?
ভড়কে দেয়ার কোনো মানে হয় না–
আজকাল ইচ্ছে করেই তুমি এ বাড়ি মাড়ানো ছেড়ে দিচ্ছো। খুব হিশেব করে পা বাড়াচ্ছো সবসময়, ধীরে ধীরে একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছো নিজেকে–
স্রেফ বাজে কথা!
এ বাড়ির কেউ তোমাকে কিছু বলেছে নাকি?
বলেছে। খোকা কিটকিট করে হেসে বললে, বলেছে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে যাকে বলে একেবারে তুলোধোনো করে ছাড়বে!
মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মানে? একরোখা জেদি ভঙ্গিতে জিগ্যেস করলে নীলাভাবী।
লেব্বাবা, এ-যে দেখি উকিলের জেরারও কান কাটে!
কি ব্যাপার খুলে বলে–নীলাভাবী হাত চেপে ধরলো।
মারবে নাকি? গ্যাঁড়াকল তো মন্দ নয়! খোকা একটু থেমে তারপর বললে, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, বুঝতে পারছি। ইচ্ছে করেই আসি না, আসা হয়ে ওঠে না–
তবে আগে যে বলতে আমার জন্যে তোমার মন কাঁদে, না দেখে থাকতে পারো না?
আসলে তোমার মনের কথাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম–
চালাকি মারছো?
বুঝলে না–খোকা বললে, ওটা ছিলো তোমাকে ফাসাবার একটা কায়দা, যাকে বলে স্রেফ ধাপ্পা!
বিশ্বাস করি না, বুজরুকিটা মারছো এখন!
বিশ্বাস না করার কি এমন আছে এতে? অসহিষ্ণু হয়ে খোকা বললে।
আমি খুব ভালো করেই জানি সেসব কথা নিছক বুজরুকির ছিলো। তোমার মুখে আমি কষ্টের ছাপ দেখতে পেতাম সে সময়, কোনো লাভ নেই অস্বীকার করে। এখন তোমার সে চেহারা আর নেই। এতো অল্প সময়ের মধ্যে তুমি কতো বদলে গিয়েছে, আশ্চর্য!
খোকা মটমট করে আঙুল মটকে বললে, আমার চর্বি হয়েছে, ভরাপেটে শুধু ঢেকুর উঠছে–
এতো চাপা স্বভাব তোমার! আজ আমি উত্তর না নিয়ে তোমাকে ছাড়ছি না, মনে রেখো!
ঘাট মানছি বাবা! আসলে কি জানো, আমার মেটামরফসিস হয়েছে; আমি শালা গ্রে গর স্যামসার মতো বিটকেল পোকা বনে গিয়েছি। সবই ওই ব্রেনটনিকের গুণ, যে রেটে ঝেড়ে টনিক চালাও তুমি
তোমার মগজে নতুন একটা কিছু ভর করেছে, আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।
অত-ই যখন বোঝো তখন ঘটা করে এতো বাজিয়ে দেখার কি আছে! তোমার চোখ তো আর চোখ নয়, এক্স-রে মেশিন, মগজ এস্তেক দেখতে পাও।
তোমার ওই কূটকচালে ভাবনা-চিন্তাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করো, তাতে তোমার নিজেরই উপকার হবে, জীবনে আনন্দের দাম নিছক কম নয়। নিজের সম্পর্কে মনের ভিতর কোনো গ্লানি পুষে রাখতে নেই, তুমি মূখ হলে এসব কথা তুলতাম না। নিজেকে, নিজের চিন্তা-ভাবনাকে, নিজের অভিরচিকে কারা বোকার মতো ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত তা জানো? যারা অগোচরে নিজের সর্বনাশ চায়
থট রিডিং-এ মাস্টার হয়ে উঠেছে দেখছি। থামলে কেন চালিয়ে যাও–
সব কথায় বাগড়া মারো কেন?
তুমি যখন এক নিশ্বাসে কথা বলতে থাকো–খোকা নরোম করে বললে, তখন অদ্ভুত দেখায় তোমাকে, তোমার ভিতর থেকে তখন অন্য কেউ কথা বলে। এরপর থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে স্টাডি করতে হবে তোমাকে। এখানে একটা কথা আছে, আমি রাক্ষুস-খোক্ষস নই, আমার হার্ট একটা চড়ইপাখির চেয়েও হালকা, পালকের চেয়েও পলকা, এতো বেশি করে সত্যের ব্যবচ্ছেদ না করাই ভালো, আমার ভিতর কেঁপে ওঠে, টলে যায়–
তোমার কাছে বোধহয় সিগ্রেট নেই, আনিয়ে দেবো?