ভিতরের সব বনকার থেমে যায় এক সময়, খোকা বললে, ব্যাস ব্যাস, থামো থামো–মিউজিক কলেজের কাছে নেমে গেল খোকা।
কিছুক্ষণ কড়া নাড়ানাড়ির পর দরোজা খুলে দিলো সিদ্দিকাভাবী, নীলাভাবীর সতীন। বয়েস গড়িয়েছে ঢের, প্রায় রাজীব ভাইয়ের সমবয়েসী মনে হয়।
কে খোকা নাকি? ভিতরে এসো। দরোজা বন্ধ করে সিদ্দিকাভাবী বললে, অসুখ-বিসুখ ছিলো বুঝি?
কই না তো?
অনেকদিন এমুখো হওনি, তাই বলছি—
সময় পাই নি।
চাকরি-বাকরিতে ঢুকে পড়েছো বুঝি?
কই আর!
বোনটাকে তো একবারও নিয়ে এলে না?
আনবো আনবো করে হয়ে ওঠে না আর কি!
হবেও না কোনোদিন, তোমরা সব এক রসুনের গোড়া।
একটা টুলের উপর টেবিলফ্যান চড়িয়ে সেটাকে চালিয়ে দিলো সিদ্দিকাভাবী। কাজের ভিতর থেকে কথা বলাটা সিদ্দিকাভাবীর পুরানো অভ্যেস; নিছক কথার প্রয়োজনে কখনও সময় খরচ করতে চায় না। খাটের তলা থেকে একটা পিকদান টেনে বের করতে করতে কিছুক্ষণ পর বললে, খেয়েছো?
হ্যাঁ।
সত্যি তো?
হ্যাঁ, সোজা বাড়ি থেকেই আপনাদের এখানে আসছি।
বোবো তাহলে, তোমার নীলাভাবী কুয়োতলায়–
উঠোনের দিকের দরোজার পর্দাটা ভালো করে টেনে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় সিদ্দিকাভাবী। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে খোকা। সিদ্দিকাভাবীর সামনে সবসময় সন্ত্রস্ত থাকে সে, মনে হয় অতি অল্পকালের মধ্যেই তাকে শিউরে উঠতে হবে। এমনভাবে কথা বলে, মনে হয় হাঁড়ির ভাত টিপছে, তারপর মাড় গালবে।
একজাতের স্ত্রীলোক আছে যারা কেবল একজন পুরুষের স্ত্রী হবার মানসেই জন্মায়। উচ্ছে ভাজা, মিষ্টি কুমড়োর ঘন্ট, শজনে ডাটার ঝোল, এসবে তাদের হাত পাকানো থাকে। সেলাই-ফেঁড়, পুরানো শাড়ি কাপড়ের বদলে কাপ-ডিশ কেনা, বছর না ফুরোতেই বাচ্চা বিয়ানো, দিব্যি ডুবে থাকে এইসবের ভিতর। ঠিক এই গ্রপে পড়ে না সিদ্দিকাভাবী। বরং বলা যায়, একটা জলজ্যান্ত হেঁয়ালি; মাড়িচাপা এবং ভিতরগোঁজা কিসিমের। সাতেও নেই পাঁচেও নেই, উপর থেকে কতকটা এই রকমই, অথচ গোটা সংসারটাকে অতি সহজে শক্ত মুঠোর ভিতর পুরে রেখেছে।
ঘরটা থমথমে। ছোট্ট একটা মেয়ে ঘামে চাবচুব হয়ে খাটের একপাশে ন্যাতার মতো পড়ে আছে, নাল গড়াচ্ছে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। খুব সম্ভব পড়শিদের কোনো মেয়ে, নীলাভাবীদের কারো কোনো সন্তানাদি নেই। ঝুপঝাপ পানি ঢালার শব্দ আসছে কুয়োতলা থেকে। থেমে থেমে আবার গুনগুনিয়ে উঠছে নীলাভাবী। কাচের চুড়ি বাজছে। দুহাত ভরা কাচের চুড়ি নীলাভাবীর। কাচের চুড়ি পরার বেজায় শখ; হামেশাই কুটকাট করে ভাঙে আর মন খারাপ হয়, সেই জন্যেই এতো অনুরাগ নীলাভাবীর।
রঞ্জুকে আনতে হবে একদিন। বলেও দেখেছে একবার রঞ্জুকে; গায়ে মেখে সে উড়িয়ে দিয়েছে। তোর খাতিরের জায়গা, আমাকে নিয়ে আবার টানাটানি কেন মুখের ওপর বলেছিলো রঞ্জু।
কেমন যেন রুদ্ধশ্বাস, মুখোশপরা এই বাড়িটা; সবসময় গুমোট, ভ্যাপসা গরম। চাপা অসন্তোষের অনচ্ছ আচ্ছাদনের ভার সহ্য করতে না পেরে থেকে থেকে কাতরাচ্ছে বাড়িটা, অহরহ তুলতুলে ভয় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে; ভালোও লাগবে না হয়তো রঞ্জুর। এ বাড়িতে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো নীলাভাবী। নীলাভাবী না থাকলে শুশানপুরী হয়ে যেত। বাড়িটা।
খোকাবাবু যে, কখন এলে?
এই তো, কিছুক্ষণ!
পথ ভুলে বুঝি?
কতকটা তাই–
মাথায় সপসপে চুলে লাল গামছা জড়িয়ে রোদ থেকে তোলা গুচ্ছের কাপড় পাঁজা করে নীলাভাবী ঘরে ঢুকতেই সবকিছু বদলে গেল। কি স্নিগ্ধ নীলাভাবীর মুখ! নাকি গোসল করার পর সবাইকেই অমন মনে হয়। দেশটাকে খোলামকুচির মতো হাতে পেলে পুরো ঢাকা শহরটাকেই একটা হামামখানা বানিয়ে দেওয়া যায়, মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করে খোকা।
খুব বুঝি দেশোদ্ধার করে বেড়াচ্ছো?
কই আর—
কেন, এখন তো সকলের ঐ একই কাজ!
তুমি তো জানোই নীলাভাবী, আমি সকলের দলে পড়ি না–
পড়ো ঠিকই, জানতে পারো না! সারা দেশ কিভাবে গজরাচ্ছে! রান্নাঘর থেকে সিদ্দিকাভাবীর গলা শোনা গেল, এক গ্লাস শরবত তৈরি করে দাও ওকে—
একটু বোসো, চটপট গোছগাছ করে নি, তারপর তোমার শরবত–
খোকা খচে উঠলো। বললে, নিকুচি করি তোমার শরবতের, দিনটাই আজ মাঠে মারা গেল। এই এক জঞ্জালে জীব মেয়েলোক! আজ বরং চলি!
একেবারে ঘোড়ায় চড়ে এসেছো দেখছি, ব্যাপার কি?
কোথায় একটু ফ্রি থাকবে, আড্ডা মেরে ঘচাং করে কেটে পড়বো, তা নয়, যত্তোসব উড়ো ঝক্কি। চুড়ি বাজিয়ে গোসল করা, শুকনো কাপড় ভাঁজ করা, চুলঝাড়া, রাবিশ রাবিশ!
নীলাভাবী হেসে বললে, তুমি এসেছো বুঝেই চুড়ি বাজাচ্ছিলাম, কি বুঝলে?
বুঝেছি–
কচু বুঝেছো, যা একখানা মাথা তোমার! যাও, আমার ঘরে গিয়ে পাখা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে বোসোগে, চটপট সব সেরে আমি এই এলাম বলে–
শালার বাড়িটা যেন পাখার একটা জীবন্ত বিজ্ঞাপন খটটাই মেজাজে বললে খোকা।
নীলাভাবীর ঘরটা এ বাড়ির ভিতর একেবারেই স্বতন্ত্র। কোথাও কোনো খুঁত নেই, পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো, চকচকে-তকতকে, সামান্য একটু আঁচড়ও পড়ে নি দেয়ালের কোথাও। মনে হয় এই ঘরটার সঙ্গে বমকে থাকা বাড়িটার কোনো সম্বন্ধ নেই: থাকলেও তা এমনই জটিল এমনই গোলমেলে যে সে সম্পর্ক নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। বরং ঘুরিয়ে বললে বাড়িটাই একটি স্ববিরোধ হয়ে যায়।
এ ঘরে অধিষ্ঠান যার, সে যেন সহসা কোনো সুদূর নক্ষত্রালোক থেকে রহস্যময় কারণে পৃথিবীতে আবির্ভূত; বিলকিলে থুথুকে নোংরা আশ্রয়কে সে স্বপ্নের ভিতরে নিয়ে যায়। বিছানাটা দেখলে বোদলেয়রের সেই প্রবল-মধুর আলস্যময় বিড়াল কবিতাগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।