পারাটা একটা বিদকুটে মানসিক দুরবস্থা, জটিলতাজর্জর অস্বাচ্ছন্দ্য; এইসব নচ্ছার এলোমেলোমির কোনো হাত-পা নেই–হিজিবিজিকাটা একটা দলামোচড়া কাগজ মনের ভিতরের পকেটে ফস করে হাত চালিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়।
বেবিট্যাক্সি থেমেছিলো হাত তোলা দেখে, তাতে চড়ে বসলো সে। আপাতত সুনির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই, পালে যখন হাওয়া লেগেছে কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠিকই ভিড়বে।
রমনা গ্রিন আর রেসকোর্সের মাঝের রাস্তার সেগুনবীথিতে মড়ক লেগেছে, পাতাগুলো ঝলসে যাচ্ছে, ন্যাতাকুড়নি পাতা-কুড়নি ফ্যালনা মেয়েরা জাফরিকাটা ছায়ায় কেউ আসন-পিড়ি হয়ে কেউ ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে চুলে বিলি কেটে উঁকুন খোঁটাখুঁটিতে মশগুল। মাঠটাকে খোকার মনে হয় দুপুরবেলায় ঝলসে ওঠা সবুজপানায় ভরা একটা মস্ত দিঘি। কালিবাড়ি যেন শিয়ালমুখো আনুবিস; দিঘির দাম কুঁড়ে মুখ তুলে রেখেছে, পারলৌকিক যাত্রায় গোটা শহরের আত্মাকে সে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটুট পার হয়ে ডানে বাঁক নেওয়ার পর খোকার মনে হয় সারিবদ্ধ অশ্বথের বিপন্ন ডালগুলো ঝা-ঝ রৌদ্রে হাহাকার করছে। পিচ গলছে। সারা রাস্তার গায়ে ঝরাপাতা আঠার মতো লেপ্টে আছে, যেন অতিকায় চিতাবাঘের গায়ে উ উ করে উঠছে এক প্রবল পরাক্রান্ত ক্রোধান্ধ দুপুর।
গণ্ডারের মতো দুপুর, ছ্যাকড়ামার্কা ঝরঝরে বেবিট্যাক্সির ঝাঁকুনি, চরম মানসিক বিশৃঙ্খলা, সবকিছু একজোট হয়ে ভিতরে ভিতরে রহস্যময় দিগদর্শনের কাজ করে, বেবি, সেগুনবাগিচা ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে যায় খোকার।
আবার সেই সেগুনবাগিচা। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছি ক্রমাগত, আমি খোকা, কতো কুকাণ্ডের যে পাণ্ডা, একজন পাজির পা ঝাড়া; স্রেফ বাইরেই মনোরম প্লাস্টিক পেন্ট, ভিতরের সব দেয়াল নোনাধরা, চটা ওঠা, খাস্তা, উত্তাল তরঙ্গময় সামুদ্রিক বিছানায় উপুড় হয়ে পড়েছিলাম, ফেননিভ একটি শরীর মুহুর্মুহু তোলপাড় করছিলো বিছানায়,—এইভাবে খোকার যাবতীয় স্মৃতি মাংসাশী হয়ে যায়, সেখানে আতশবাজির ধুম শুরু হয়,—উত্তেজনা যত তীব্র ততো মধুর, যত মধুর ততো অপবিত্র, অপবিত্রতা ইহলোকে যৌবনদান করে আমাদের, জাহাজের মতো বন্দর থেকে বন্দরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই যৌবন।
এইসব মনে হয় খোকার। খোকা এও জানে, টাইটানিক যে জাহাজ, একদিন ভরাডুবি হয় তারও।
ভিজে কুকুরের মতো গা থেকে কাদা ঝাড়তে থাকে এক ধরনের অনুভূতি; অপরাধবোধ সম্পর্কে তার ধারণা খুব একটা স্বচ্ছ নয়, কেবল এই অনুভূতির আলগা স্পর্শে অল্পবিস্তর সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে সে। আমাদের ভিতরে যে কতো প্রবল মানুষের আস্তানা পাতা, যারা প্রায় সকলেই অচেনা, কখন যে কার করায়ত্ত আমরা, ইহকালে তা জানা যাবে কখনো, আগেও ভেবেছে খোকা এসব। যে স্তন দৃপ্ত খেলোয়াড়ের হাতের বল হতে চায়, দন্তক্ষতের মালা জড়াতে চায়, নির্বোধ শিশুর ঠোঁটে তা অমন উগ্র অথচ মধুর হয় কিভাবে, খোকার মাথায় তা খেলে না; তার শুধু মনে হয়, একা নই, কেউ-ই আমরা একা নই।
দুপুরে সামান্য একটা গা ঢেলে দিয়ে বিছানায় নিছক আরাম করে বসার সূত্র থেকে কত বড় অঘটনই না ঘটতে পারে। ঝপ করে, যেন কারো হাত ফস্কে পড়ে গিয়েছিলো এক সুগোল স্বপ্নের ইঁদারায়, যেখানে নিজের কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা-হিম পলেস্তারার গায়ে পাক খেয়ে শঙ্খিল গতিতে ব্যর্থই প্রতিধ্বনিত হয়। হাঁসফাঁস করতে থাকে খোকা। বহুদিন আগে গাছ থেকে খসে পড়া একটা ঝুনো নারকেল সে, গরু-ছাগল মুতে ভাসানো মাটিতে পড়ে আছে, একটা ফোঁপল সন্তর্পণে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নিপুণতায় চাপ দিচ্ছে ভিতরে। খোকা যেন একটা নিরেট জগদ্দল গুণ্ডার নাম। বডি বিল্ডার খোকা, ইয়ার্স ডে-তে বলরুমের শ্যান্ডেলিয়ার ওয়ালথার পিপিকের গুলিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে হোটেল ইন্টারকন কালো র্যাপারে ঢেকে দিয়েছিলো খোকা, খোকা গুণ্ডা, গুণ্ডা আর কোল্ড ব্লাড মার্ডারার। রাক্ষুসে আকাশ থেকে বস্তার মুখ খুলে রাশি রাশি ধাতব মুদ্রা ঢেলে দিচ্ছে কেউ মাথার উপর, কানের পাশে বৃষ্টির মর্মান্তিক কলরোল, ভয়ঙ্কর এবং প্রচণ্ড, কানে তালা লেগে যায় খোকার। কি বিশ্রী কি জঘন্য এই নামটা! তার আসল নাম অর্থাৎ জাহেদুল কবির খোকা নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বারবার। ভোজবাজির মতো এমনভাবে শিকড় গেড়ে গঁাট হয়ে আছে নামটা, যে, কখনো তার মূলোচ্ছেদ সম্ভব নয়। তলে তলে বজ্জাতি আর নষ্টামির শক্ত বর্মের কাজ করে এই নামটা। নাম তো নয়, একটা বিষের ভড়। ক্ষুদ্র মাকড়সা নিজ হইতে সুতা ও জাল সৃষ্টি করিতে সমর্থ, সৎ সেরূপটি পারেন না, যদি সৎ নিজেকে বিকৃত না করেন তবে সৃষ্টি হয় না খোকার ভিতরের ঘোঁট পাকানো ঝড়ে ভুশ ভুশ করে ধুলো উড়তে থাকে; জোড়া ঘোড়ার চালে পড়ে মার খাচ্ছে এবার। ছেঁড়া কাগজের মতো ফরফর করে উড়তে থাকে খোকা; যৌবন এমন ক্ষমাহীন কেন, সে শুধু তার আপন অধিকার খুঁজে বেড়ায়, এক অসতর্ক মুহূর্তে অন্যায়েরও একটা অধিকার আবিষ্কার করে ফেলে সে। কি ভাবে নীলাভাবী এখন, জেনে দেখলে কি হয়, নীলাভাবীর উত্তরটা কি ধরনের হবে? আর যদি ধরে নেয় একজন লম্পট কামাচারী নিছক কূট উদ্দেশ্য হাসিল করার ফিকির এঁটে নতুন করে উস্কে দিচ্ছে, তাহলে উল্টো বিপদ। ঠিক সেইদিন থেকে তার মানসিক স্থৈর্যের। পাট ভাঙা লাট খাওয়া অবস্থা যেদিন সামান্য একটু আস্কারা পেয়ে নীলাভাবীর সারা বয়েস দুহাতে ঘাঁটাঘাঁটির পর একেবারে তছনছ করে দিয়েছিল সে, এবং খোকা খুব ভালো করেই জানে, এসব অন্য কারো বোঝার ব্যাপার নয়; যেমন নীলাভাবী। সেদিন সেই আকস্মিক ছন্দপতনের পরও বিন্দুমাত্র তারতম্য ঘটেনি নীলাভাবীর চলনে-বলনে, খোকার মনে হয়েছে এক অপ্রত্যাশিত নিপুণতায় সমানে সূক্ষ্মতর ভারসাম্যও রক্ষা করে চলেছে নীলাভাবী। নিজেকে লাগসই করে মানিয়ে নেওয়া, নিজেকে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নেওয়ার ভিতর আড়ষ্টতা না থাকাটাই সম্ভবত বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা, নিদেনপক্ষে এই ধরনের একটা হালকা সাদা প্রবোধ খাড়া করে স্বস্তির উৎসমুখের দিকে যায় খোকা; জেলিফিশের মতো এই থলথলে মেরুদণ্ডহীন স্বস্তির গায়ে থুথু ছিটিয়ে কোনো লাভ নেই, দুর্গন্ধময় হাজতের ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে চায় খোকা, তোমরা যারা আমার পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের উদ্দেশ্যেই বলা : পৃথিবীর সকল নীলাভাবীরাই এক একটি জ্বলন্ত কামকুণ্ড, ফুটন্ত টগবগে আগ্নেয়গিরি, যার নিদারুণ লাভাস্রোতে পীত ধবল কালো বাদামি রাশি রাশি খোকার দগ্ধাবশেষ গড়ান খেয়ে চলে।