চট করে জানালার পাশে সরে এলো খোকা। ইলেকট্রিসিটি ফেল করেছে, গোটা শহরেই নেমেছে প্রেতায়িত অন্ধকার।
কি ব্যাপার? কান পাতার চেষ্টা করে রাজীব ভাই বললে, স্লোগান শুনতে পাচ্ছো?
একদল তরুণ হুটোপুটি করে ছুটতে ছুটতে রাজীব ভাইদের পাশের বাড়িতে ঢোকে।
কি ব্যাপার? প্রতিবেশীদের একজনকে ডেকে জিগ্যেস করলে রাজীব ভাই।
ট্রাক কি ট্রাক আর্মি নামছে রাস্তায়!
কি সর্বনাশ! খোকা ভেঙে পড়ে বললে, এখন উপায়। ঘরে ফিরবো কি করে?
ব্যস্ত হয়ো না, আগে ব্যাপারটা বুঝতে দাও—
সামনের রাস্তায় বেরিয়ে একজন তরুণের মুখ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সম্ভবমতো যাবতীয় পরিস্থিতির কথা জেনে নিতে থাকে রাজীব ভাই।
খোকা মরিয়া হয়ে বললে, যেতে আমাকে হবেই, যে করেই হোক, ঘরে রঞ্জু একা–
অসম্ভব! রাজীব ভাই খোকার একটা হাত ধরে বললে, যাবে কি করে? খুব ভুল হয়ে গিয়েছে, আমার উচিত হয় নি তোমাকে এভাবে ধরে রাখা। এখন সমস্ত রাস্তাঘাট বন্ধ।
রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। চারদিকে খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ওরা বলছে সৈন্যরা সমস্ত ছাত্রাবাস আর পুলিশ লাইন ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।
কিন্তু রঞ্জু–
অচৈতন্যপ্রায় খোকা থপ করে বসে পড়ে মেঝের ওপর, চোখে অন্ধকার দেখে সে।
রাজীব ভাই খোকার পিঠে একটা হাত রেখে বললে, শক্ত হবার চেষ্টা করো। এভাবে মুষড়ে পড়ে কোনো লাভ নেই। আমি বেরিয়ে দেখছি এখনো কোনো উপায় আছে কি না।
মুখের কথা প্রায় মুখেই থেকে যায়, চতুর্দিকে মুহুর্মুহু প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ফেটে পড়তে থাকে। প্রাণভয়ে ভীত রাস্তার মানুষজন আত্মরক্ষার জন্যে যে যেদিকে পারছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে এলোপাতাড়ি দুদ্দাড় করে ছুটে পালাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে কে একজন চিৎকার করে বললে, সাবধান। ভাইসব! আপনারা আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকুন! সৈন্যরা। পাগল হয়ে গেছে! কুত্তার বাচ্চারা গরু-ছাগলের মতো মানুষ মারছে। এখন!
খুব কাছাকাছি হডাম করে একটা মর্টারের শেল এসে পড়লো। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে গোটা বাড়ি থরথর করে কেঁপে ওঠে। বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে। ধরাশায়ী মানুষজনের চিৎকার আর্তনাদে দ্রুত নারকীয় পরিস্থিতি নেমে আসে চতুর্দিকে। জানালার
পালা ভেদ করে উপর্যুপরি কয়েকটি বুলেট দেয়ালে এসে পড়ায় ঝুরঝুরিয়ে পলেস্তারা খসে পড়ে। এক অলিখিত নিয়মে হামাগুড়ি দিয়ে সকলেই খাটের তলায় আশ্রয় নিলো। হাত-পা পড়ে গিয়েছে খোকার। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তার মাথার খুলির ফোকরে ভয়ঙ্কর এক শূন্যতায় লেলিহান অগ্নিশিখার মতো করাল মৃত্যু লকলকে জিভ বের করে অবিরাম ভয়াবহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকে।
» ০৯. তারপর দুটি রাত
তারপর দুটি রাত, মাঝখানে একটি দিন।
খোকা জানে না কিভাবে সময় কেটেছে। কোনো হিসেব নেই তার কাছে। কেবল এইটুকু মনে আছে, অনৈসর্গিক আচ্ছন্নতার ভিতর জুবড়ে থেকেও সে অনুমান করতে পারছিলো কি পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকা চলেছে শহরময়। জানালার ফাঁকে চোখ রাখলেই দেখা যায় চতুর্দিকে ছত্রাখান মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন, ঝাঝরা; শহর জুড়ে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন, তপ্ত বাতাসের হলকায় দগ্ধ মাংস আর বারুদের কটু গন্ধ।
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিলো দেয়াল। জানালার সামনে একটা খাট খাড়া করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো রাজীব ভাই, গুলি লাগলো মুখে।
ঠিক কখন রাজীব ভাইয়ের মৃত্যু হয়, খোকার তা জানা নেই। অন্ধকার প্রেতপুরীতে তিনটি জড়বৎ প্রাণী রদ্ধশ্বাসে কেবল প্রহর গুনেছে। সবকিছু আয়ত্তে এলেই ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাবে উন্মত্ত সৈন্যদল, একটি প্রাণীও বাঁচবে না, এই এখনও যেমন কুকুর বিড়াল সামনে যা পড়ছে তোপের মুখে উড়িয়ে দিচ্ছে এক ধারসে,–থেকে থেকে এইসব ভেবে শিউরে উঠছিলো খোকা।
সকালের আলোয় রাজীব ভাইয়ের মুখ দেখে তার রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিলো, মনে হয়েছিলো নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ, বিকৃত তিরস্কার। গুলিতে রাজীব ভাইয়ের মুখের একপাশের চোয়াল উড়ে গিয়েছিলো।
সন্ধ্যার আগেই শুরু হয়েছিলো মুখের দিকে পচানি ধরার। অনির্দিষ্টকালের জন্যে কারফিউ, কোনো প্রশ্নই উঠে নি সৎকারের। প্রতি মুহূর্তেই গোলাগুলির তুমুল শব্দ, মাঝে মাঝে দূরে কোথাও ঘটছে উচ্চণ্ড বিস্ফোরণ; বসে বসে নিজের মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া কারো কিছুই করণীয় ছিলো না।
এই প্রথম জীবনের চেয়েও বড় বলে মনে হয়েছিলো এক একটি রাত্রিকে; বিস্ফোরণের শব্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছিলো প্রতিটি পল অনুপলকে। জীবনের অর্থ তখন একটাই, প্রাণের ভার; নারকীয়তার এমন রুদ্রমূর্তি আর কখনো দেখে নি খোকা।
ক্রমাগত ফুলছিলো রাজীব ভাইয়ের লাশ। এক বিকট গহ্বর ঠেলে বেরিয়ে আসছিলো ক্ষত-বিক্ষত জিভ। যাবতীয় ধ্বংসস্তুপের ভিতর এই মানুষটিই সবচেয়ে বেশি অনাত্মীয় হয়ে উঠেছিলো তিনটি প্রাণীর কাছে; কেননা রাজীব ভাইয়ের লাশের গন্ধে সকলেরই নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।
১০. খোকার গল্পের এখানে সমাপ্তি
খোকার গল্পের এখানে সমাপ্তি।
নুরুদ্দিন, মওলা মুরাদ, বেলী নীলাভাবী কিংবা রাজীব ভাইয়ের পরিচিত সেই খোকা সম্পর্কে এই ঘটনার পর বলবার মতো আর কী-ই বা এমন থাকতে পারে! দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এমন এক সর্বনাশা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভিতরে গিয়ে পড়েছিলো যে খোকা নিজের কাছে নিজেই বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিলো না।