আছে কি নেই সেটা তোমার ভাবনা। থাকলে ভালো হয়, এটাই সত্যি। তুমি একটা সামান্য মেয়েমানুষ, কিন্তু জুয়ার দান দেয়ার জন্যে কোমর বেঁধে লেগেছো। মানুষের সংসারে বাস করা উচিত, না ভাগাড়ে?
খাতায় নাম লিখিয়েছি, এই বলতে চাও তো?
তুমি চাও না, সত্যি করে বলো তো, তুমি চাও না আমি তোমার ভিতর যুঁইফুল ফোঁটাই?
খোকার কথা শেষ না হতেই প্রচণ্ড একটা থাপ্পড় পড়লো তার গালে। বিছানার উপর টলে পড়লো খোকা। চোখে আঁচল চেপে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখলো সে নীলাভাবীকে!
এই ভালো,–গালে হাত বুলিয়ে আরাম পেল খোকা!
খুব ভালো হলো, চড়ের কথা জীবনভর যেন আমার মনে থাকে, মনে রাখবে তো খোকা? ভাই আমার, মনে রেখো!
ভালোই লিখেছিলো বেলী। বেলী লিখেছিলো, তোমাকে তো পারি নি, তাই তোমার একলা বিছানাটাকে তছনছ করে দিলো বেলী। একদিন এই গালে নীলাভাবীর ঠোঁটজোড়া তার সুখশয্যা রচনা করে বিশ্রাম নিয়েছিলো; আমাকে পারে নি, তাই তছনছ করে দিয়েছে আমার গাল।
ভালোই লিখেছিলো বেলী। বেলী লিখেছিলো, কেন লেখো, কেনই-বা ধ্বংস করো; নীলাভাবীকে উস্কে দিয়েছিলাম আমিই, আবার আমিই তাতে পানি ঢেলে দিয়েছি।
খোকা ভাই আমার, আমার এ গাল বড় আদরের, বড় যত্নের, জীবনভর মনে রেখো, থাপ্পড় পড়েছে আমার এই গালে, আগুনের শিখার মতো পাচটা আঙুলের দাগ বসেছে এই গালে। বলো লজ্জা লজ্জা লজ্জা! বলো ঘৃণা ঘৃণা ঘৃণা! বলো কি অশ্লীল এ দাগ!
আর লিখো না, দলামোচড়া করে ছুড়ে দিও না খাটের তলায়। অনেক লিখেছো, অনেক ধ্বংস করেছো, ঢের হয়েছে, এখন তোমার খেলা বন্ধ করো, খোকা, ভাই আমার চেয়ে দ্যাখো কি ক্লান্তি! কি বিতৃষ্ণা!
সন্ধ্যা পর হয়ে রাত্রি গড়িয়েছে সেই কখন। কিছুই জানে না খোকা। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো সে পড়েছিলো; ডিমের খোলের ভিতর একটু একটু করে সে প্রাণ সঞ্চয় করছিলো। সে জানে, আজ তার নবজন্ম হয়েছে। আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে, তার আর কোনো সমস্যা নেই, সমস্যার পীড়ন নেই, সবকিছুর সমাধান করে ফেলেছে সে।
ঘরে ফিরে জামার বোতাম খুলতে খুলতে রাজীব বললে, শুনলে কিছু?
কই না।
শুনলাম সবকিছু মিটমাট হয়ে গেছে।
কিছুই শুনি নি! খোকা অপরাধীর মতো স্বীকারোক্তি করলে। ইয়াহিয়া-ভুট্টো নাকি ছদফা মেনে নিয়েছে। টেলিগ্রামও বেরিয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ভিড়, এখন কেবল রেডিও-টেলিভিশনে সরকারি ঘোষণার অপেক্ষা–
রক্তারক্তিটা তাহলে এড়ানো গেল শেষ অব্দি!
কি জানি, হয়তো শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে শয়তানগুলোর। এছাড়া আর কোনো পথ তো ছিলো না, দেখাই যাক!
হাতমুখ ধুয়ে এসে রাজীব ভাই বললে, কথা হয়েছে নীলার সঙ্গে? যা ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলো আমাকে। তোমার অসুবিধের কথা আমি বুঝি, বুঝলে কি হবে, এমন গোঁ ধরে বসেছে, বাধ্য হয়ে তোমাকে বলতে হলো। এখন বোঝানো যাবে। তুমি বোধহয় অব্যাহতি পেলে।
খোকা উঠি উঠি করায় রাজীব ভাই বললে, আরে বোসো বোসো, যাবেই তো, এসো একহাত হয়ে যাক আজ–
দাবার বোর্ড আর ঘুটি বের করলে রাজীব ভাই। খোকার কাছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ মনে হলো। কিছুটা ধারালো রাজীব ভাইয়ের মুখ। হুট করে দাবার বোর্ড টেনে বের করাকে খুব সহজে নিতে পারে না খোকা।
কয়েক চালেই হাতি আর মন্ত্রীর যৌথ আক্রমণ রচনা করলো রাজীব ভাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুলকি চালে ঘোড়াও এসে জুটলো। ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়ে গেল খোকা। রাজা সামলাতে গিয়ে এক এক করে বহু খুঁটি হারাতে হলো তাকে; তারপর সামান্য একটু অসতর্কতার সুযোগে। ঘোড়ার চালে কিস্তি দিয়ে তার শেষ শক্তি মন্ত্রীকেও ছোবল দিলো রাজীব ভাই। রিজাইন দিয়ে মুখ রক্ষা করলো খোকা।
পরের বার খুব ধীরে-সুস্থে চাল দেয়া শুরু করলো রাজীব ভাই। খোকার দৃষ্টি এড়ায় না, খুব ঠাণ্ডা মাথায় বোড়ের জাল বিস্তার করে অসাধারণ নিপুণতায় আক্রমণের পরিকল্পনা ফেঁদে চলেছে ভদ্রলোক। খোকাও শক্ত দেয়াল তুলে দিলো এক এক করে।
রাজাকে দুর্গের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত রেখে শত্ৰুপুরীতে ঘা দেয়ার জন্যে হাতির রাস্তা পরিষ্কার করে ফেললো। প্রথমে সংঘর্ষটাকে কেন্দ্রস্থলে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্যোগ নিলেও অজ্ঞাত কোনো কারণে তা বাতিল করে একপাশ থেকে একটা বোড়ে ঠেলে দিলো রাজীব ভাই খোকার হাতির পথে, খোকা মনে মনে হাসলো, সে জানে বোড়েটা বিষাক্ত নীলাভাবীর চেয়েও। সে লোভ সংবরণ করলে।
এবারে একটা কালো ঘোড়া সামনে দিলো; বিধ্বংসী টোপ, খোকা লোভ সংবরণ করলে এবারও। সে লক্ষ্য করে, এই টোপ না গেলার ফলে রাজীব ভাইয়ের সমস্ত খুঁটির অবস্থান ঢিলে হয়ে পড়েছে। ইচ্ছেমতো খোকা এখন রাজাকে ন্যাংটো করে নাচাতে পারে, কান ধরে টেনে আনতে পারে। না, উচিত হবে না, খোকা মতো বদলে ফেললে। উচিত হবে না রাজীব ভাইকে হারানো। যেমন করেই হোক জিতিয়ে দিবে ভদ্রলোককে। যথেষ্ট মার খাচ্ছে বেচারা ভিতরে ভিতরে, খুব করুণ। মনে হলো খোকার। শেষ পর্যন্ত এ খেলায় সে ইচ্ছে করেই জিতিয়ে দিলো রাজীব ভাইকে।
এটা শেষ গেম। তুমি কিন্তু তেমন মনোযোগ দিয়ে খেলছো না। এ গেমটা তোমার ছিলো!
জেতার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই খোকার। চোখে ধূলো দেয়ার জন্যে কিছুক্ষণ সে আস্ফালন করলো। বিচ্ছিন্নভাবে এধারে-ওধারে ব্যর্থ আক্রমণই চালালো; জোরালো পরিকল্পনা না থাকায় তার সবকটি আক্রমণই অতি সহজে প্রতিহত করে ধীরে ধীরে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে রাজীব ভাই। অব্যাহত চাপের মুখে ক্রমাগত পিছু হটতে থাকে খোকা। ঠিক এই সময় নিঃশব্দে আলো নিভে গেল।